নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু বাংলা: পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ি সড়কে আসছে আগামী বছরের শুরুর দিকে। এ গাড়ি তৈরি হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ‘বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’। প্রায় একশ একর জায়গার ওপর কারখানা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন চলছে গাড়ি উৎপাদনের প্রস্তুতি। মধ্যবিত্তের সামর্থ্য বিবেচনায় এই গাড়ির দাম হবে নাগালের মধ্যেই। বিদ্যুতে চলবে বিধায় প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে অনেক কম। থাকবে না ধোঁয়া, হবে না বায়ু দূষণ। দেশে সরকারী ও বেসরকারী খাতে গাড়ি সংযোজনের আরও দুটি কারখানা থাকলেও নিজস্ব গাড়ি তৈরির কারখানা এটিই প্রথম।
চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজীর সমুদ্র উপকূলে প্রায় ৩৩ হাজার একর জায়গার ওপর গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। সেখানে বেশকিছু কারখানা উৎপাদনে যাবার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিদ্যুতচালিত গাড়ির কারখানা। গাড়ি শিল্পে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এই কারখানা পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ি যেমন তৈরি করবে তেমনিভাবে এটি হবে দেশে গাড়ি শিল্পের মাইলফলক।
বেজা (বাংলাদেশ অর্থনীতি অঞ্চল কর্তৃপক্ষ) সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে যে কটি প্রতিষ্ঠান একেবারে উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালির প্রযুক্তিকে ধারণ করে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করবে এ প্রতিষ্ঠান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে প্রতিষ্ঠানটিকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০০ একর জায়গা। ২০১৮ সালে উদ্যোক্তারা কারখানা স্থাপন কাজ শুরু করেন। মাঝে করোনা পরিস্থিতির কারণে গতি শ্লথ হলেও এখন কাজ শেষ করে এনেছেন তারা। সেখানে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন শুধু আধুনিক প্রযুক্তির যুগে প্রবেশই নয়, একইসঙ্গে তা হতে যাচ্ছে গাড়ি শিল্পে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।
বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উদ্যোক্তারা বলছেন, তারা আগামী বছরের প্রথম দিকেই সড়কে নামাতে চান নিজেদের উৎপাদিত ইলেকট্রিক গাড়ি, যা চলবে উচ্চক্ষমতার ব্যাটারিতে। এ গাড়ির ৭০ শতাংশ উৎপাদিত হবে বাংলাদেশে। বাকি ৩০ শতাংশ হবে সংযোজন। প্রাথমিকভাবে বছরে ৩৫ হাজার প্রাইভেট কার, ৫০ হাজার তিন চাকার যান এবং ১ লাখ ইলেকট্রিক মোটরসাইকেল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
সেডান কার ছাড়াও কারখানাটিতে তৈরি করা হবে মাইক্রোবাস, কাভার্ড ভ্যান এবং মিনি ট্রাকও। প্রথমে তাদের জায়গা বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে। কিন্তু গাড়ি শিল্পের মতো কারখানার জন্য বন্দর সুবিধা প্রয়োজন বিধায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বরাদ্দ চাওয়া হয়। মীরসরাইয়ে ১০০ একর জায়গা বরাদ্দ পাওয়ার পর দ্রুত গতিতে কারখানা নির্মাণের কাজ শেষ করে আনা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে এই গাড়ি উৎপাদন কারখানার জন্য ব্যয় করা হচ্ছে ১০ কোটি মার্কিন ডলার, যা প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা। বরাদ্দ পাওয়া ওই ভূমিতে হবে মোট তিনটি কারখানা। এর একটিতে তৈরি হবে গাড়ি। দ্বিতীয়টিতে যন্ত্রাংশ, ব্যাটারি ও চার্জার, যে প্রতিষ্ঠানটির নাম হবে বাংলাদেশ লিথিয়াম ব্যাটারি লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের অংশীদার চীনের উহান সায়ান টেকনোলজি কোম্পানি।
তৃতীয় কারখানাটিতে তৈরি হবে মোটর কন্ট্রোলার চার্জার। সব মিলে মোট বিনিয়োগ হবে ৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
কেমন হবে গাড়ির দাম
উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান জানাচ্ছে, তাদের উৎপাদিত গাড়ি হবে মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। এ ব্যাপারে তারা দেশে একটি জরিপ চালিয়েছেন। এতে বেরিয়ে এসেছে যে, বাংলাদেশে অনেক চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাদের মাসিক আয় ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে। সে বিবেচনায় ৭ লাখ থেকে ১৪ লাখ টাকার মধ্যে ক্রেতার হাতে সেডান কার তুলে দিতে চান তারা।
গাড়ি কেনা যেন সহজ হয় সেজন্য দেড় লাখ টাকা ডাউনপেমেন্ট দিয়ে বাকিটুকুর জন্য কিস্তির সুবিধা থাকবে। এছাড়া উৎপাদিত অন্য গাড়িগুলোর জন্যও কিস্তির সুবিধা রাখা হবে।
যেহেতু বিশ্ব এখন পরিবেশবান্ধব গাড়ির দিকে ঝুঁকছে, সেহেতু বিপুল সাড়া পাওয়া যাবে বলে আশা করেন তারা।
ব্যাটারিচালিত বৈদ্যুতিক গাড়িতে পরিচালন ব্যয় হবে অনেক কম। পেট্রোলচালিত গাড়ি চালাতে যেখানে প্রতি হাজার কিলোমিটারে খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টাকা, সেখানে বৈদ্যুতিক গাড়িতে ব্যয় হবে ১ হাজার ২৫০ টাকা, অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে দেড় টাকারও কম। বিদ্যুতচালিত হওয়ায় এ গাড়ির যান্ত্রিক ক্ষমতাও বেশি হবে। আর পরিবেশবান্ধব দিকটি তো থাকছেই।
এই গাড়ির ব্যাটারি চার্জ দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখছেন উদ্যোক্তারা। এজন্য সড়কের পাশে বিদ্যমান রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোর পাশেই থাকবে ব্যাটারি চার্জিং ইউনিট। এছাড়া মালিক যেন নিজ বাড়িতেও ব্যাটারি চার্জ দিতে পারেন, সে সুবিধাও থাকবে।
গাড়ি সংযোজনের আরও দুই কারখানা
দেশে গাড়ি উৎপাদন প্রথম কারখানা মীরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে। তবে সরকারী ও বেসরকারী খাতে আরও দুটি গাড়ি সংযোজন কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে একটি বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের আওতাধীন প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড এলাকায় প্রায় ২৫ একর জায়গার ওপর ১৯৬৬ সালে এ কারখানাটির যাত্রা শুরু হয়েছিল গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ করা হয়। বার্ষিক ১ হাজার ৫শ’ গাড়ি সংযোজন ক্ষমতা রয়েছে এই কারখানার। সেখানে সংযোজিত হয় প্রাইভেটকার, জীপ, বাস, ট্রাক, পিকআপ, এ্যাম্বুলেন্স ও ট্রাক্টর। এছাড়া জাপানের মিতসুবিশি কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী প্রগতিতে সংযোজিত হচ্ছে মিতসুবিশি সেডান কার ও পাজেরো জিপ। মূলত এখানে বিদেশ থেকে আমদানি করা পার্টস সংযোজনের মাধ্যমে গাড়ি তৈরি হয়ে থাকে। তবে কিছু স্পেয়ার পার্টসও তৈরি হয় এ কারখানায়।
এছাড়া অন্যতম শীর্ষ শিল্প গ্রুপ পিএইচপি ফ্যামিলিও রয়েছে গাড়ি সংযোজন কারখানা। মহানগরীর সাগরিকায় প্রতিষ্ঠিত এ কারখানায় সংযোজিত হয় বিখ্যাত ‘প্রোটন সাগা’ ব্র্যান্ডের গাড়ি। ইতোমধ্যেই এ প্রতিষ্ঠানের প্রাইভেটকার রাস্তায় নেমেছে। দেশেই সংযোজন বলে পিএইচপির গাড়ি মিলছে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চেয়ে কম দামে। প্রতিষ্ঠানটি গাড়ির পাঁচ বছরের ওয়ারেন্টি এবং দেড়লাখ কিলোমিটারের বিক্রয়ত্তোর সেবা দিচ্ছে।
প্রায় ছয় বছর আগে বাংলাদেশের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল পিএইচপির কর্ণধার সুফী মিজানুর রহমান প্রতিষ্ঠিত। সেখানেই মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে সুফী মিজানুর রহমানের আলাপ হয় বাংলাদেশে গাড়ি তৈরির বিষয়ে। এরপর ফলপ্রসূ সমঝোতার ভিত্তিতে বাংলাদেশেই কারখানা প্রতিষ্ঠা করে পিএইচপি ফ্যামিলি।
প্রসঙ্গত, শিল্পায়ন ও বৈশ্বিক অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জ্বালানি তেলের চাহিদা। সে চাহিদা কোনও এক সময় এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাতে পারে যে, জীবাশ্ম জ্বালানী দিয়ে তা পূরণ করা আর সম্ভব হবে না। তাছাড়া জলবায়ু মানুষের বাসযোগ্য রাখতে বিশ্বব্যাপী এখন সর্বাধিক জোর দেয়া হচ্ছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ওপর।
জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশ এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে ব্যাটারিচালিত বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে আসার। এর সঙ্গে সামিল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশও। গাড়ি শিল্পে ভালোভাবে অনুপ্রবেশ বিলম্বে হলেও বাংলাদেশের শুরুটা হচ্ছে উন্নত ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে।
আরো পড়ুন: