ইব্রাহীম খলিল জুয়েল:
করোনা পরিস্থিতি বাংলাদেশে যে কোনো সময় ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে- বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্কবাণী থাকলেও এখনো পর্যন্ত দেশটি স্বস্তির খবরই দিচ্ছে। বিশ্ব পরিস্থিতির তুলনায় বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে তাকালে ধরিত্রীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ; শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, স্বাস্থ্যসেবায় তাদের থেকে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ যেন আতঙ্ক কাটিয়ে অনেকটাই সাহস জোগানোর বার্তা দিচ্ছে।
গত ৮ মার্চ করোনার প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আজ (১ এপ্রিল) পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৪ জন। মারা গেছেন ৬ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৬ জন।
আমেরিকা, ইতালি, স্পেনের মৃত্যুর মিছিলের দিকে তাকালে আমরা আতঙ্কিত হই। আমাদের বুক শুকিয়ে যায়। ভাবি, এতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে কোনো কারণে স্প্রেড করলে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। এমন আশঙ্কা হয়তো সবার মাঝেই। যদিও সরকার যথেষ্ট প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিন্তু আমরা যদি পরিস্থিতিটা পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখবো- আমরা এখনো অনেক ভালো আছি। আক্রান্ত এবং মৃত্যু দুটির হারই আমাদের দেশে অনেক কম, যদি তুলনা করি ইউরোপ-আমেরিকার মৃত্যুর মিছিলের সাথে। এ পর্যন্ত প্রবাসে অর্ধশতাধিক বাংলাদেশী মারা গেছেন। দেশের জীবনের চেয়ে উন্নত প্রবাস জীবনও তাঁদের ধরে রাখতে পারেনি। প্রতিটি মৃত্যুই শোকের, বেদনার। পৃথিবীর যে প্রান্তেই ঘটুক না কেন। যে জাতি, ভাষার মানুষই প্রাণ হারান না কেন।
বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত যে নিয়ন্ত্রণে আছে, বিশ্লেষকদের মতে তার কয়েকটি কারণ:
১. দেশব্যাপী লকডাউন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়া না হলেও কার্যত লকডাউনে রয়েছে গোটা দেশ। এ ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ত্বরিৎ এবং কঠোর কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছেন এবং এই ছুটি মেনে সবাই যাতে নিজ নিজ বাড়িতে থাকতে বাধ্য হন (সেলফ/হোম কোয়ারেন্টাইন) তার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছেন। সিভিল প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য সেনাবাহিনী নামিয়েছেন। সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে গণমাধ্যমে এবং নিজ দলের সাংগঠনিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণ এবং ৩১ মার্চ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বিশ্বব্যাপী অভিন্ন শত্রু, মারণঘাতী এই করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে আমাদের কী করতে হবে, কী স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে হবে তা বুঝিয়ে বলেছেন। দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া আরো বিভিন্ন বক্তৃতাতেও তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সরকার প্রধানের এসব আহ্বান ও পদক্ষেপ দেশের নাগরিকরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনও আন্তরিকভাবে কাজ করে চলেছে।
২. বাংলাদেশে এখন পুরোপুরি গরমের মওসুম শুরু হয়ে গেছে। গরম করোনা ভাইরাসের বড় শত্রু । ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর গত কয়েকদিনের তাপমাত্রা।
৩. বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ।
৪. ইলেক্ট্রনিক, অনলাইন, প্রিন্ট- সব গণমাধ্যম খুবই গুরুত্ব দিয়ে দায়িত্বশীল খবর, বিশ্লেষণ, টক-শো এবং সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। যেখানে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ, চিকিৎসকগণ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাগণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন, করণীয় বলে দিচ্ছেন।
৫. জনপ্রতিনিধি এবং স্বেচ্ছাসেবকগণ পরিস্থিতি সামলাতে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
জার্মান প্রবাসী সাংবাদিক মাহমুদুল হাসান (মাহমুদ মনি) গত ৩০ মার্চ কথা বলেন ইতালির ইউনিউভার্সিটি অব বলোগনা’র ডিপার্টমেন্ট অব মেডিকেল অ্যান্ড সার্জিকেল সায়েন্সেজের প্রফেসর ড. মারিনা টাডোলিনির সঙ্গে। বিশিষ্ট এই চিকিৎসক সামনের দিকে থেকে করোনা-ভাইরাস মোকাবেলায় লড়াই করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও সাবেক কর্মকর্তা এবং ইনফেকশাস ডিজিজ এক্সপার্ট।
প্রায় ৪৫ মিনিটের ভিডিও-কলে কথা প্রসঙ্গে ড. মারিনা টাডোলিনিবাংলাদেশের জন্য বেশকিছু দিকনির্দেশনা প্রদানসহ ইতিবাচক কিছু তথ্য উপস্থাপন করেন। তিনি মনে করছেন:
>> গ্রীষ্মকালীন দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থা হয়তো ইতালি বা ইউরোপের মতো ভয়াবহ হবে না।
>> বাংলাদেশে গরমের কারণে ভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটাই কম হবে। ১০-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই ভাইরাস তুলনামূলক বেশি ছড়ায় বলে মনে করেন ড. মারিনা।
>> তাঁর মতে, বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা যেমন কম থাকবে তেমনি কম থাকবে মৃত্যুর হারও।
>> তবে কোনো রকমের লক্ষণ ছাড়াই করোনা শরীরে থাকতে পারে দিনের পর দিন। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে এমনটা দেখেছেন তিনি ।
অনেকে আবার এমন মতও দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশে টেস্টের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় রোগী শনাক্ত হচ্ছে না। ভেতরে ভেতরে যদি সংক্রমণ হতে থাকে তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
সংক্রমণ ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী বলেন, ‘সংক্রমণের পর থেকে সংখ্যা বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু মাঝখানে তিনদিন কোনো কেসই ছিল না। আমার মনে হয় সমস্যাটা হলো আমরা খুব বেশি পরীক্ষা করতে পারছি না।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, ‘ডব্লিউএইচও এর প্রধান জোর দিয়ে বলেছেন টেস্ট, টেস্ট, অ্যান্ড টেস্ট। সীমাবদ্ধ টেস্ট করার ফলে আমরা সবগুলোকে টেস্ট করতে পারবো না।’
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. রিদওয়ানুর রহমান বলেন, ‘হঠাৎ করে লকডাউন ছেড়ে দিলে আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’
তবে আশা ও শঙ্কার দোলাচলে নানা বিশ্লেষণের পরও আশার জায়গা এটা যে, বাংলাদেশে আজকের নতুন মৃত্যুর ঘটনার আগে সবশেষ মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছিল এক সপ্তাহ আগে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন তিনজন। সব কিছু মিলিয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে, সাধারণ জ্ঞান দিয়ে এটাই বলা যায় যে অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো।
তবে আজ বুধবার আইইডিসিআর প্রথম জানায় যে, ঢাকায় সীমিত আকারে কম্যুনিটি সংক্রমণ হচ্ছে বলে তারা সন্দেহ করছেন। এ খবরটি অবশ্যই আশঙ্কার। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা এবং অতি আবশ্যক না হলে ঘর থেকে বের না হওয়াই এর সমাধান হতে পারে। স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা যেমনটা বলছেন।