বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ধূমকেতু ডটকম-এর বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। আজ প্রকাশিত হলো [১০ম পর্ব]। চোখ রাখুন ধূমকেতু ডটকম-এ।
নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একটি হলো ‘বম’। বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায় এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্যে তাদের বসবাস। তাদের প্রায় সকলেই খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে তাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। তাদের নবান্ন উৎসবের নাম ‘থ্লাই থার কুট’ । নিজস্ব ভাষা থাকলেও পৃথক বর্ণমালা নেই। সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, বম জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। তারা একটি প্রান্তিক ভাষাগত সংখ্যালঘু এবং উপেক্ষিত জাতিগোষ্ঠী। তাদের সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, শিক্ষার অনগ্রসরতা, পেশাগত বৈচিত্র্যের অভাব, ভূমি হ্রাস, অসচেনতা, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ না থাকা, জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন না করা ইত্যাদি বহুবিধি কারণে তাদের উন্নয়ন আশানুরূপ নয়। তাই তাদের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বিত আদিবাসীবান্ধব উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একথা সত্য যে, বম জাতিসহ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারার বাইরে রেখে কার্যকর উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মূল স্রোতের সঙ্গে বম জাতিগোষ্ঠীর যোগাযোগ খুব বেশি নেই।
ধর্ম ও ভাষা:
বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই জানান, ১৯২৭ সালে বান্দরবানে বসবাসকারী সব বম জনগোষ্ঠী খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। বমদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও পৃথক বর্ণমালা না থাকায় সে সময় ধর্ম প্রচারের জন্য পাদ্রিরা রোমান হরফে বম ভাষায় বাইবেলসহ নানা ধর্মীয় গ্রন্থ লেখেন। ৬০ দশক থেকে রোমান হরফে বম ভাষায় নানা উপকথা, গীতিকবিতা, লোকসংগীত প্রভৃতি লেখা হচ্ছে। কিন্তু এসবের চর্চা এখন একেবারেই কম।
পাহাড়ি নেতা জুয়ামলিয়ান আরো বলেন, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর বমদের অনেক নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতিনীতির পরিবর্তন ঘটেছে। বিলুপ্ত হয়েছে আদিধর্ম প্রকৃতি পূজা, গো হত্যা উৎসব, বিভিন্ন অলৌকিকে বিশ্বাসসহ নানা রকম প্রাচীন ঐতিহ্য।
জনসংখ্যা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন নাথানা লনচেও বম। তিনি ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের সীমান্তসংলগ্ন ভারতের মিজোরাম রাজ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বমরা বাস করে। বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি ও বান্দরবান সদর উপজেলায় বর্তমানে বম জনসংখ্যা ১১ হাজার ৬৩৭ জন। তাদের বেশির ভাগের বসবাস রুমা উপজেলায়।
সামাজিক অবকাঠামো:
আদিবাসী নেতা দীপায়ন খীসা বলেন, অতীতে বম জনগোষ্ঠীর লোকজন নদী থেকে দূরে দুর্গম পর্বত শিখরে তাদের গ্রামগুলি নির্মাণ করত। গ্রামগুলির চারপাশে শক্ত গাছের খুঁটি পুঁতে বেষ্টনী তৈরি করা হতো। বমরা মাটিতে খুঁটি পুঁতে উঁচু পাহাড়ের উপর প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তাতে বাড়িঘর নির্মাণ করে। তাদের ঘরকে মাচাং বলা হয়। মাচাং বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। সামাজিক আচার-আচরণ, বিচার সালিশ এবং বিবাদ মীমাংসার জন্য এদের নিজস্ব সামাজিক অবকাঠামো আছে। এই কাঠামো সামগ্রিকভাবে সামাজিক আচার-ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বম সমাজের কেউ অতি প্রয়োজন না হলে নিজেদের মধ্যে সংঘটিত কোনও বিবাদ মীমাংসার জন্য আদালত বা অন্য কোনও সরকারি সংস্থার শরণাপন্ন হন না। আজও বমরা তাদের জীবন পরিচালনা করে বম কাস্টমারি ল’ গ্রন্থের নির্দেশিকা অনুযায়ী।
বমদের বাঁশনৃত্য তাদের জীবনেরই অপরিহার্য অংশ। এটি পরিবেশ থেকে নেওয়া নৃত্যানুষ্ঠান। বমদের চেরাউ নৃত্য ও সঙ্গীত আসলে কোনও আনন্দের বা উৎসবের নৃত্য বা গান নয়। এ নৃত্য ও গান পরিবেশিত হয় বম পরিবারের দুঃখ ও শোকের দিনে। বিশেষ করে পরিবারের কারও অকাল বা অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে এই গান করা হয়। শোকের সময় মানুষকে সান্ত্বনা ও সাহস দেওয়ার এটাই বমদের রীতি।
উৎসব:
বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, ফসল তোলার মৌসুমে বমদের ব্যস্ততা যেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। জুম থেকে নতুন ধান কেটে ঘরে ফসল তোলার হিড়িক। এটি পাহাড়ের জুমিয়া সমাজের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধান কাটার পাশাপাশি তারা জুম থেকে নানা ধরনের ফসল তোলে। জুম করার আগে যেমনি সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ কামনা করে পূজা-পার্বণ করা হয়, তেমনি ফসল তোলার পর সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পূজা–পার্বণের রীতিও জুমিয়া সমাজে প্রচলিত। বমদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। “থ্লাই থার কুট” বমদের একটি নবান্ন উৎসব। নবান্ন উৎসব হলেও এটি সাধারণত অন্যান্য উৎসব থেকে কিছুটা ভিন্ন।
তারা এ উৎসব পালন করে থাকে জুমের উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলার পর। মূলত সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে নিজ নিজ গ্রামের প্রতিটা গির্জায় এই বিশেষ উৎসব পালন করে। যা “থ্লাই থার কোট” নামে পরিচিত। এ উৎসব বম জাতির বাইরে ভিন্ন নামে লুসাই ও পাংখোয়ারা পালন করে থাকে। “থ্লাই” মানে ফসল “থার” হল নতুন অর্থাৎ “থলাই থার” অর্থ হল নতুন ফসল। উৎসবের তারিখ নিজেদের মন্ডলির সুবিধা অনুযায়ী ঠিক হয়ে থাকে। তবে তা অবশ্যই রবিবার হতে হবে।
এই দিনে গ্রামের প্রত্যেক পরিবার থেকে বিভিন্ন ফলমূল যেমন কলা, ভুট্টা, পেঁপে, পেয়ারা, আখ থেকে শুরু করে যার যা আছে সেগুলো তারা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করার জন্য গীর্জায় নিয়ে আসে। সারা সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে তাদের এ নবান্ন উৎসব চলে। গীর্জায় তারা সবাই মিলেমিশে কুশল বিনিময় করে তাদের ফলমূল এবং ভোজের আয়োজন করা হয়ে থাকে যা একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়।।
বড়দিন বা খ্রিস্টমাস এলে বম এলাকায় আনন্দের ধুম পড়ে যায়। শুধু বম সম্প্রদায়ই নয়, জেলার অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী লোকজনও উৎসবে যোগ দেয়। বমরা নেচে-গেয়ে আনন্দ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে পালন করে বড়দিন। তরুণ-তরুণীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে।
কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার উজ্জ্বল আজিম ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে বাস করা বম জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে, তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে। একটা সময় বমরা সবাই জুমচাষের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বর্তমানে প্রায় ৫০ শতাংশ বম পরিবার ফলদ-বনজ বাগানের ওপর নির্ভরশীল।
বান্দরবানের বাইরে রাঙামাটিতেও বম সম্প্রদায় রয়েছে। বম জনগোষ্ঠী অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। তাদের ছোট ছোট সমস্যা থাকলে সেগুলো সবাই মিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, কর্মমুখী শিক্ষা ও বাস্তবমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করে বম সমাজকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
আরো পড়ুন:
জুম চাষ ত্রিপুরাদের প্রধান পেশা | বর্ষবরণে মেতে উঠে ‘গড়িয়া নৃত্যে’