নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: স্কুল-কলেজে ফল (রেজাল্ট) দেওয়ার পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। বাংলা, ইংরেজি, গণিতের মতো বিষয়ভিত্তিক নম্বর দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীর বিভিন্ন যোগ্যতা এবং দক্ষতারও মূল্যায়ন থাকবে রিপোর্ট কার্ডে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ২০২৩ সাল থেকে চালু হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে এ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ গুণাবলির মূল্যায়ন সংবলিত এই রিপোর্ট কার্ড কেবল চূড়ান্ত ও বার্ষিক পরীক্ষায় নয়, বরং পার্বিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক পরীক্ষায়ও কার্যকর থাকবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত প্রস্তাবিত এই শিক্ষাক্রম এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে।
এনসিটিবি প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রমের চূড়ান্ত খসড়ায় এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রচলিত নম্বরভিত্তিক সনদ বা রিপোর্ট কার্ডের পরিবর্তে বর্ণনামূলক বহুমাত্রিক সনদ বা রিপোর্ট কার্ডের প্রচলন করা হবে। রিপোর্ট কার্ডে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জনের অগ্রগতির প্রতিফলন থাকবে। জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ বিকাশের অবস্থাও রিপোর্ট কার্ডে উল্লেখ থাকবে।’
এতে আরও বলা হয়, রিপোর্ট কার্ডের মাধ্যমেই মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। রিপোর্ট কার্ডের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবার যৌথভাবে শিক্ষার্থীর শিখন অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা নিতে পারে। শ্রেণিশিক্ষক সরাসরি অভিভাবককে রিপোর্ট কার্ড দেখাবেন এবং শিক্ষার্থীর বিভিন্ন অর্জন ও উন্নয়নের দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করবেন।
নতুন শিক্ষাক্রমে বলা হয়, ‘পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই রকম ধারা অনুসরণ করা হবে। পাবলিক পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ডে গ্রেডিংয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর জ্ঞান দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ বিকাশের অগ্রগতির প্রতিফলন শিখনকালীন মূল্যায়নের ফলাফলের ভিত্তিতে উপস্থাপন করা হবে।
সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষার্থী মূল্যায়নের রিপোর্ট কার্ড এবং পাবলিক পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে প্রণয়ন ও প্রচলন করা হবে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সিস্টেম-নির্ভর মূল্যায়ন ও রিপোর্টিং ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। যার মাধ্যমে মূল্যায়ন ও রিপোর্টিংয়ের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে।’
ফল প্রকাশের নতুন এই পদ্ধতি কার্যকরের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করে বলা হয়, ‘সাময়িক, বার্ষিক ও পাবলিক পরীক্ষায় বহুমাত্রিক সনদের প্রচলনের পাশাপাশি নির্দিষ্ট যোগ্যতা, দক্ষতা, অধ্যায়, শ্রেণিকাজ বা ইভেন্ট শেষেও পারদর্শিতার সনদ প্রদানের প্রচলন করা যেতে পারে।’
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সঙ্গে ফল প্রকাশের পদ্ধতিও বদলে যাবে। বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে এখন কাজ করছেন।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে, উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পৃথক পাবলিক পরীক্ষা রয়েছে। এই দুটি পরীক্ষার ফল মিলিয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল তৈরি করা হবে। এ দুটি পাবলিক পরীক্ষায় তিনটি আবশ্যিক বিষয়ে ৩০% শিখনকালীন মূল্যায়ন ও ৭০% সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে।
শিখনকালীন মূল্যায়ন হলো পাঠদানকালে শিক্ষক ক্লাসরুমে যেসব কাজ দেবেন, সেগুলোর ভিত্তিতে মূল্যায়ন। তিনটি নৈর্বাচনিক/ বিশেষায়িত বিষয়ে বিষয়-কাঠামো ও ধারণায়ন অনুযায়ী সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রজেক্ট ওয়ার্কভিত্তিক মূল্যায়ন, প্র্যাকটিক্যাল ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে।
এই স্তরে প্রায়োগিক একটি বিষয় বা ঐচ্ছিক বিষয়ে হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে।
মাধ্যমিকে দশম শ্রেণির সিলেবাসের ওপর ভিত্তি করে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। দশম শ্রেণির ১০টি বিষয়ের মধ্যে পাঁচটি বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান) সামষ্টিক মূল্যায়ন ও শিখনকালীন মূল্যায়ন উভয়ের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীর ফল ঘোষণা করা হবে।
অবশিষ্ট পাঁচটি থিমভিত্তিক বিষয় (জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি) বিদ্যালয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ে সামষ্টিক মূল্যায়নে নম্বর থাকবে ৫০% এবং বাকি ৫০% নম্বর থাকবে জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য। এই ৫০ নম্বর সরাসরি ক্লাসরুম শিক্ষকের হাতে।
কোচিং বাণিজ্যের শঙ্কা: ফল প্রকাশের নতুন এই পদ্ধতিকে ইতিবাচক হিসেবে নিলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান, অভিভাবক ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠান রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীর দক্ষতা বিচার করে নম্বর দেবেন শিক্ষক, এটা শুভ উদ্যোগ। এভাবে শিক্ষকদের হাতে বিপুল নম্বর ও অসীম ক্ষমতা দেওয়া হলো। তবে আমাদের সমাজ বাস্তবতায় সব শিক্ষক তো আর সমান নন। যারা ‘কোচিংবাজ’ শিক্ষক তারা এই ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন। তারা তাদের কাছে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে আসার জন্য চাপ দেবেন। এর প্রতিকার কীভাবে হবে?
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু বলেন, অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, স্কুল বেইজড অ্যাসেসমেন্টের (এসবিএ) নামে একশ্রেণির শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যের রীতিমতো পসরা বসিয়েছিলেন। তাদের কারণে সাধারণ অভিভাবকদের নাভিশ্বাস উঠেছিল। পরে তা বাতিল করা হয়। এখনও রাজধানীর বিভিন্ন নামিদামি স্কুলের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের জিম্মি করে রমরমা কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন, যা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, নতুন কোনো পদ্ধতির নামে কোচিং ব্যবসার ভূত যেন শিক্ষকদের কাঁধে চেপে না বসে সেটিই আমাদের চাওয়া।
শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. আব্দুল হালিম এ বিষয়ে বলেন, সৃষ্টিশীল এবং জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক রিপোর্ট কার্ড প্রচলনের উদ্যোগটি ভালো, তবে বাস্তবায়নটা খুব চ্যালেঞ্জিং হবে। এ উদ্যোগের মূল চ্যালেঞ্জ হলো- শিক্ষকরা এ পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত কিনা। সব বিষয়ে তো পাবলিক পরীক্ষা হবে না। দশম শ্রেণি শেষে পাঁচটি বিষয়ে সামষ্টিক পরীক্ষা হবে। বাকি পাঁচটি বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। তাহলে ওই পাঁচটি বিষয়ের সব নম্বরই সরাসরি শিক্ষকদের হাতের মুঠোয়। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখি, শিক্ষকের হাতে নম্বর বেশি থাকলে অভিভাবকরাই ওই শিক্ষকের কাছে সন্তানকে প্রাইভেট পড়াতে উৎসাহ দেখান। আবার উল্টোটিও ঘটে। অনেক অভিভাবক বাধ্য হন সন্তানকে নির্দিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়াতে। এমন বাস্তবতায় এই নতুন পদ্ধতি সফলভাবে কার্যকর করা কতটুকু সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। আবার অনেক শিক্ষকেরই মেধার ঘাটতি থাকতে পারে। তারা তো সব কিছুতে ফাঁকি দিয়ে পার পেতে চান। এমন হলেও শিক্ষার্থীর মেধার সঠিক মূল্যায়ন শ্রেণিকক্ষে হবে না।
অধ্যাপক ড. আব্দুল হালিম বলেন, আমাদের সমাজ কাঠামো, অবস্থান, মানসিকতা ও কালচারের পরিবর্তন না ঘটলে এবং শিক্ষকদের নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপরে প্রশিক্ষণ না দিলে এটি বাস্তবায়ন করা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
আরো পড়ুন: