অরুণ কুমার গোস্বামী :
“শোন একটি মজিবরের থেকে
লক্ষ মজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ…”
— গৌরী প্রসন্ন মজুমদার/অংশুমান রায়
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এবং অংশুমান রায়ের সুর করা একটি জনপ্রিয় বাংলা গণসঙ্গীতের প্রথম পংক্তি উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের রক্তঝরা দিনগুলোতে মুক্তিপাগল বাঙালিদের হৃদয়ে সঞ্জীবনি বার্তা বয়ে আনত এই গান। এই পংক্তি সম্পর্কে প্রথমেই যে পর্যবেক্ষণ হতে পারে তা হচ্ছে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার সমাজের একজন ‘ব্যক্তি’ সম্পর্কে তাঁর আবেগ ও অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। এই অনুভূতিটি বাঙালিদের নিকট জনপ্রিয় আর আলোচিত এই ব্যক্তি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বিশ্বখ্যাত নিউজ উইক ম্যাগাজিনে যাঁকে একদা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার কর্তৃক কাব্যিকভাবে উপস্থাপিত পর্যবেক্ষণের সরল অর্থ করলে বিষয়টি এরকম দাঁড়ায় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্ঠস্বরের ধ্বনি তাঁর লক্ষ অনুসারীর মাধ্যমে আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে তাঁর প্রাণের চেয়েও ভালোবাসতেন।
বঙ্গবন্ধুর কারণে তাঁর অনুসারীরাও ‘বাংলাদেশ’ বাংলাদেশ’ বলেছে। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে কয়েক কোটি ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু এই একজন যাঁর কথা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বলছেন, তিনি ব্যতিক্রম। নিজ কর্মগুণে মহত্ত্বের শীর্ষতম স্থানে যিনি পৌঁছেছিলেন।
ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) এর বাংলা বিভাগ ২০০৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত “Gratest Bengalis of all times” শিরোনামে এক জরিপ পরিচালনা করে। বিবিসির ১২ মিলিয়ন স্রোতা বিশেষত বাংলাভাষী স্রোতারা যারা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে আছেন তারা এই জরিপে অংশগ্রহণ করেন। এই জরিপের ফলাফল প্রক্রিয়াকরণের জন্য ২০ দিন সময় ব্যয় হয়। এবং ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ১লা বৈশাখে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
“20 Greatest Bengalis” এর তালিকায় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার কর্তৃক বর্ণিত ‘মজিবর’ এর নাম প্রথম স্থানে এসে যায়। পর্যবেক্ষকদের মতে এরকম ফলাফলই স্বাভাবিকভাবে আশা করা গিয়েছিল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিবিসির স্রোতা জরিপে বঙ্গবন্ধুর পরেই সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্থান পেয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। বাংলাদেশের সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিদের সাধারণ অনুভূতি হচ্ছে হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ আর চেতনায় নজরুলকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ও মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রক্তের সাগর পেরিয়ে বিশ্বে বাঙালিদের একমাত্র স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট বিশাল হৃদয় ধারণকারী বঙ্গবন্ধুর বক্ষ বিদীর্ণ করেছিল। এই দিনটি বাঙালি জাতি ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালন করে। প্রশ্ন হচ্ছে ব্যক্তিত্ব তত্ত্ব ও সামাজিকীকরণ তত্ত্বের আলোকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির ‘ব্যক্তিত্ব’ কি বিশ্লেষণ করা সম্ভব?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যক্তিত্ব তত্ত্বের আলোকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব এখনও বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের গবেষক বিশ্লেষণ করেননি। ভবিষ্যতে হয়তো করবেন। এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ব্যক্তিত্ব তত্ত্বের আলোকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অনুসন্ধানের সম্ভাব্যতার উপর আলোকপাত করা হচ্ছে। ব্যক্তিত্ব তত্ত্ব (Personality Theory) হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতির একটি অন্যতম শাখা।
অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে, মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতির আর একটি শাখা সামাজিকীকরণ তত্ত্বের (Socialization Theory) সাথে এক সাথে ব্যক্তিত্ব তত্ত্ব অধ্যয়ন করা হয়ে থাকে। রাষ্ট্র কিংবা সমাজের যে কোনো একটি বিষয় শুধু একটি পদ্ধতির আলোকে পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসন্ধান করা সম্ভব নয়। সে হিসেবে বর্তমানের প্রচেষ্টাটি একটি অসম্পূর্ণ এবং সংক্ষিপ্ত আলোচনা মাত্র।
ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে গবেষণার ক্ষেত্রে সমসাময়িককালে জার্মান মনোবিজ্ঞানী এরিক হমবার্গার এরিক্সনকে (১৯০২-১৯০৪) সর্বাধিক প্রভাবশালী গবেষক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে গবেষণার ক্ষেত্রে এরিক্সনের তত্ত্বটি মনৈতিহাসিক (Psychohistory) নামে পরিচিত। মনোইতিহাস হচ্ছে, ‘মনোবিশ্লেষণ এবং ইতিহাস পদ্ধতির সমন্বয়ে ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক জীবন অধ্যয়ন করা।’ এরিক্সনের পূর্বে সিগমুন্ড ফ্রয়েডও (১৮৫৬-১৯৩৯) বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জীবন পরীক্ষা করেছিলেন, তবে মনোইতিহাস তত্ত্বটি এরিক্সন পরিশীলিত করেন আর তাই এই তত্ত্বটির সাথে তাঁর নাম যুক্ত হয়ে আছে। সমসাময়িক বিশ্বে ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণী তত্ত্বের বাস্তবপোযোগিতা ও প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে তিনি অন্য যে কারও চেয়ে অগ্রগণ্য।
প্রায় প্রতিদিনই আমরা আমাদের চারপাশের লোকজনের ব্যক্তিত্ব বর্ণনা ও মূল্যায়ন করে থাকি। আমরা এটি অনুধাবন করি বা না করি লোকজন কিভাবে এবং কেন এমন আচরণ করে, এমন দৈনন্দিন ব্যবহারিক চর্চার দ্বারা ব্যক্তিত্ব মনোবিজ্ঞানীগণ ব্যক্তিত্বের ধারণা ব্যবহার করেন যা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। ব্যক্তির গবেষণার দ্বারা বেশ কিছু তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে যা কিভাবে ও কেন কোন কোন ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্যাবলীর বিকাশ লাভ করে তা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের অনেক তত্ত্ব আছে। তবে এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে ব্যক্তিত্ব পদবাচ্য দ্বারা কী বোঝানো হয়।
একটি সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা হতে পারে এরকম, ‘ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা যা একজন ব্যক্তিকে অনন্য করে তোলে ।’ এই সাথে, ব্যক্তিত্বের উদ্ভব ঘটে ব্যক্তির মধ্য থেকে এবং জীবনব্যাপী তা মোটামুটি সঙ্গতিপূর্ণ থাকে।
এ সম্পর্কে যে সব গবেষক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন স্মিথ, ব্রানার ও হোয়াইট (১৯৫৬) তাদের মধ্যে অন্যতম। এই গবেষকদের লিখিত ‘Opinion and Personality’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ব্যক্তিত্ব হচ্ছে একটি সামাজিকভাবে উৎপন্ন ফসল, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন মানব জাতির ক্ষেত্রে যা অকল্পনীয়। অর্থাৎ সমাজবদ্ধ মানুষের পরস্পর মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। সংক্ষেপে, দৃষ্টিভঙ্গী ও ব্যক্তিত্ব উভয়ই আহরিত হয়ে থাকে।
ব্যক্তিত্ব তাত্ত্বিকেরা যুক্তি প্রদর্শন করেন যে রাজনৈতিক আচরণ হচ্ছে গভীর-প্রোথিত নির্দেশক বৈশিষ্ট্য যা সচরাচর প্রথম বয়স থেকে শুরু হয়ে থাকে। সব ব্যক্তিত্ব তাত্ত্বিকেরা এক বা একাধিক মৌলিক প্রয়োজন বা তাগিদকে স্বতঃসিদ্ধ বলে গণ্য করেন যা ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পিছনে গতি উৎপাদক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
অপর দিকে সামাজিকীকরণ তাত্ত্বিকদের কেন্দ্রীয় অনুকল্প হচ্ছে আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং বিশ্বাস সরাসরি সামাজিকীকরণের এজেন্টদের মাধ্যমে শিখে থাকি, যেমন মাতাপিতা এবং স্কুল। পিতামাতা এবং শিক্ষকগণ যদি উদার গণতান্ত্রিক হন তা’হলে সন্তান ও শিক্ষার্থীদেরও উদার গণতান্ত্রিক হবার সম্ভাবনা থাকে। ব্যক্তিত্ত্বের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে । এগুলো হচ্ছে সঙ্গতি, মনোস্তাত্ত্বিক ও শারীরবৃত্তিক, অভিঘাত আচরণ ও কর্মোদ্যোগ এবং বহুবিধ অভিব্যক্তি।
অপরদিকে ব্যক্তিসত্তা গঠন সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার একটি কেন্দ্রীয় অংশ। অন্য লোকের সাথে মিথস্ক্রিয়ার পথে ব্যক্তিসত্তা জেগে ওঠে এবং গুণাবলী, সামর্থ্যসমূহ ও আচরণ সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে।
সামাজিকীকরণ একটি অব্যাহত এবং জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। সকল সমাজকেই জীবনের গতিধারা নিয়ে ব্যাপৃত থাকতে হয় যা গর্ভধারণ থেকে শুরু হয় এবং বৃদ্ধ বয়স ব্যাপী এবং চূড়ান্তভাবে মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন বয়োপ্রাপ্তি, মধ্য বয়োপ্রাপ্তি, শেষ বয়োপ্রাপ্তি, এবং মৃত্যু এই সব স্তরেই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া চলমান থাকে।
একজন মহান দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে এবং তাঁর সামাজিকীকরণ হয়েছে তাঁর পিতা-মাতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতার মাধ্যমে। দেশকে ও দেশের জনগণকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসার কারণে জনগণ তাঁকে প্রথমে ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং পরে ‘জাতির পিতা’ অভিধায় সিক্ত করেছেন। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ৩ চৈত্র, ১৯২০ সালের ২০ মার্চ, মঙ্গলবার মাগরেবের নামাযের পর রাত আটটার সময় বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা-মা উভয়েই তাঁকে বাল্যকাল থেকে আদর করে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন। আর মাতা-পিতার নিকট বাড়ীতেই তাঁর প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের কাজ শুরু হয়। এবং মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯২৭-১৯২৯ সালে ভর্তি হন। পরে ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুলে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুর দেওয়ানী আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। এসময়ে তিনি তাঁর খোকাকে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেন।
গুরুসদয় দত্ত কর্তৃক প্রবর্তিত নৈতিকতা ও দেশপ্রেমমূলক ব্রতচারী নৃত্য ছিল বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয় শরীর চর্চা। নৈতিকতা ও দেশপ্রেমমূলক এই শরীর চর্চার প্রতি শৈশব ও কৈশোর কালের আকর্ষণের কারণেই তাঁর মধ্যে আবহমান বাঙালি মানসিকতা সঞ্চারিত ও বিকশিত হয়। দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের প্রতি অনুরক্ততার কারণে শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে এক নেতৃত্ব জন্ম নেয়।
১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালে কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আবুল কালাম আযাদ কলেজ) থেকে আই.এ. এবং ১৯৪৭ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন।
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা’ হলো
(১) সত্য অন্বেষণ; (২) যে কোনো অন্যায় ও অযৌক্তিক কর্মকান্ড ও আচরণের প্রতিবাদ করা; (৩) অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি প্রবল একনিষ্ঠতা; (৪) দুর্বল ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলা; (৫) নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতি স্বভাবজাত সম্পৃক্ততা; (৬) অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা; (৭) দেশপ্রেম ও মানবতার প্রতি সহজাত আকর্ষণ।
পাকিস্তানের শুরু থেকেই তিনি বাঙালিদের স্বার্থের বলিষ্ঠ প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। শুধু তাই নয়, বাঙালিদের স্বার্থে তাঁর মধ্যে এমনকি পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৩ সালে তিনি যখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের একজন সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করেন তার মাত্র ৩ বছর আগে লাহোর প্রস্তাব পাস হয়েছে। এসময় লাহোর প্রস্তাবে ‘স্টেটস’ না ‘স্টেট’ সংযোজিত হয়েছে অথবা এটি দ্বি-জাতি তত্ত্ব বাস্তবায়নের ফর্মূলা কি না প্রভৃতি নিয়ে জিন্না যে ব্যাখ্যা দেন সে
ব্যাপারে বাঙালি রাজনীতিক আবুল হাসিম তার বিরোধিতা করে বক্তব্য বিবৃতি প্রদান করেছিলেন। আবুল হাসিমকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও সমর্থন করছিলেন।
সব মিলিয়ে মুসলিম নবাব, জমিদার, মুসলিম সমাজের বিশেষতঃ ধনীক শ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের মধ্যে একটি গণমুখী ধারার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন আবুল হাসিম ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এসময়ে মাত্র তেইশ বছরের সত্যান্বেষী মুজিব মুসলিম লীগের গণমুখী ধারার একজন সদস্য হিসেবে নিজেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেন।
তিনি যখন কোলকাতায় ছাত্র ছিলেন তখন থেকে একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা লগ্নে অবিভক্ত বাংলার জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং এ কে ফজলুল হকের ন্যায় ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে তিনি এসেছিলেন। বয়োঃসন্ধিকালে মুজিব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এবং ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের নিষ্ঠুর বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছেন। এই দুর্ভিক্ষে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন লোক মৃত্যুবরণ করেছিল। এসময়ে তিনি মহাত্মা গান্ধীর সততা, ধর্মপরায়ণতা, (রাজনৈতিক) ধর্মনিরপেক্ষতা এবং দেশপ্রেমমূলক কর্মকান্ড এবং কিংবদন্তী বিপ্লবী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস কর্তৃক ব্রিটিশ রাজকে চ্যালেঞ্জ করতে দেখেছিলেন।
বয়োঃসন্ধিকালের মুজিব এসময়ে অধ্যয়ন করেছিলেন জর্জ বার্নার্ড শ’, কার্ল মার্ক্স, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাড়া জাগানো সব কাজ।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর প্রায় ১২০০ মাইলের শারীরিক ব্যবধানে দুটি পৃথক অংশে বিভক্ত পাকিস্তান সৃষ্টির ভৌগলিক ভয়ংকরতা সম্পর্কে তিনি চিন্তিত হয়েছিলেন। এই দুই অংশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত চরিত্রও ছিল ভিন্ন। দুই অংশকে একক রাষ্ট্র কাঠামোতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের নামে জোরপূর্বক আবদ্ধ রাখার ফলে দেশের রাজধানী এবং এর অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তি নিয়ন্ত্রণকারী সর্ব্ব ক্ষমতাধর পশ্চিম অংশ কর্তৃক পূর্ব অংশের জন্য অনমনীয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক শোষণ বয়ে এনেছিল।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। এসময় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা তাদের বিভিন্ন দাবীতে আন্দোলন করছিল। শেখ মুজিব চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের এই ন্যায়সঙ্গত দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনে শরীক হন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহিষ্কার করে। দীর্ঘ ৬২ বছর পরে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে এই বহিষ্কার আদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রত্যাহার করেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বঙ্গবন্ধু যে কোনো কিছু এবং যা কিছু করেছেন সে সব কিছুই পাকিস্তানের সব প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা সামরিক শাসকেরা পাকিস্তান বিরোধী কর্মকান্ড হিসেবে গণ্য করেছেন। তিনিই ছিলেন ১৯৪৭-১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের একমাত্র রাজনীতিক যিনি ২৪ বছরের মধ্যে ১৪ বছরই কারাভোগ করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অন্যান্যদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এসময় তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং রাজবন্দী হিসেবে তিনি ফরিদপুর কারাগারে ছিলেন। ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় শেখ মুজিবও এসময় পার্টি সংগঠন ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। পার্টিকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে তিনি আতাউর রহমানের মন্ত্রিসভা (১৯৫৬-১৯৫৮) থেকে পদত্যাগ করেন এবং দলকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। এভাবে তিনি একজন ক্যারিসমেটিক সংগঠক হিসেবে দলের ওপর তাঁর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগকে অকার্যকর করে রাখতে চাইলেও শেখ মুজিব আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রথম কারাবন্দীদের অন্যতম। ১৯৫৪ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের টিকিটে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে জয়লাভ করেন। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট তিনি পাকিস্তান কন্সটিটিউয়েন্ট এসেম্বলীতে বলেছিলেন, ‘মাননীয় স্পীকার, তারা (সরকার) পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করতে চায়। আমরা সব সময়েই দাবী করে আসছি যে ‘বাংলা’ নামটি ব্যবহৃত হতে হবে। এর একটি ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকার আছে। এই নামটি আদৌ যদি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে বাংলার জনগণের নিকট প্রশ্নটি তুলে ধরা উচিত: তারা কি তাদের পরিচিতি পরিবর্তন করতে প্রস্তুত?’ শেখ মুজিবের দাবী তুচ্ছ করা হয়েছিল। এবং বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
এর কয়েক বছর পর ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্মরণে একটি আলোচনা সভায় বাঙালিদের তিনি অবগত করান যে এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত হবে। এটি ছিল ভবিষ্যতের আলো। একজন নেতার আবির্ভাবের কারণে একটি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আসন্ন। ১৯৬০-এর দশক থেকে তিনি রাজনৈতিক খ্যাতির শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করে নিতে সক্ষম হন। তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে তিনি আওয়ামী লীগকে অনেক বাঁধা বিঘ্ন ও উপদলীয় কোন্দল থেকে রক্ষা করে রাজনীতির মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে সক্ষম হন। তিনি আওয়ামী লীগকে পুনঃসংগঠিত করেন এবং এই দলটিকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ‘আমাদের (বাঙালিদের) বাঁচার সনদ’ ছয় দফা দাবীনামা পেশ করেন, যার লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্ব-শাসন। ছয় দফা অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রাধান্যের মূলে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। যদিও রক্ষণশীল মনোভাবের রাজনৈতিক লোকজন ছয় দফাকে ভালো চোখে দেখে নাই। তবে অচিরেই এটি তরুণ প্রজন্ম বিশেষত: ছাত্র, যুবক এবং শ্রমিক শ্রেণীর কাছে বেঁচে থাকার দাবী হিসেবে দেখা দেয়।
শেখ মুজিবের এইরূপ চরম রাজনৈতিক মতামতের কারণে আইয়ূব শাহী তাঁকে কারান্তরালে নিয়ে যান। এসময় তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। আইয়ুব শাসনামলের বেশিরভাগ সময়ে তিনি কারাভোগ করেন ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ এবং পরে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ এর আগ পর্যন্ত। দ্বিতীয় মেয়াদে (১৯৬১-১৯৬৯) কারান্তরালে থাকাকালে তাঁর ক্যারিসমা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তাঁকে মুক্ত করার জন্য ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণআন্দোলন সংঘটিত হয়। ফলে সে বছর ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব শাহী তাঁকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আইয়ুবের কারাগার থেকে মুক্ত হবার পরের দিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রমনা রেস কোর্সে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল গণসম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়।
এই গণসম্বর্ধনায় তাঁকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ছাত্র-জনতা তাঁর মধ্যে একজন সঠিক নেতার সন্ধান লাভ করেন। যাঁর জন্য তাঁরা সুদীর্ঘকাল ব্যাপী অপেক্ষা করছিলেন। যিনি দেশ ও দেশের মানুষের পক্ষে কথা বলতে যেয়ে সুদীর্ঘ কাল কারাভোগ করেন। ফলে আইয়ুব শাহীর শাসনামলে তাঁর স্বদেশভূমি তাঁর কাছে মুক্তভূমির চেয়ে একটি কারাগার হিসেবেই বেশি প্রতিপন্ন হয়।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র নির্বাচিত মুখপাত্র হিসেবে প্রতিপন্ন করে। ছয় দফার পক্ষে জনগণ বঙ্গবন্ধুকে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট প্রদান করে। ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর তাই এই ম্যান্ডেট অনুযায়ী তাঁর কাজ করার পালা আসে। বঙ্গবন্ধু ছয় দফার পক্ষে এত ঐকান্তিক ছিলেন যে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্সে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি সব নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ শপথ করেন যে সংবিধান প্রণয়ণকালে তিনি ছয়-দফা থেকে কখনো বিচ্যুত হবেন না। এটি জনগণের কাছে নিজের অঙ্গীকার রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক দৃঢ়তার লক্ষণ। পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অনুসৃত উপায়ে এগিয়ে যাবার ইঙ্গিতবাহী। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল তা তাঁর অন্যতম একজন প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভূট্টোর ডাইরী থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ স্টানলি উলপার্টের লেখা বইতে এই ডাইরীর লেখা উল্লেখ আছে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার প্রফেসর স্টানলি উলপার্ট এর লেখা বই ‘জুলফিকার আলী ভূট্টো অব পাকিস্তান’ ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত হয়। বস্তত পক্ষে এ বইটি জুলফিকার আলী ভূট্টোর জীবনীগ্রন্থ। এ বইতে জুলফিকার আলী ভূট্টোর ব্যক্তিগত ডাইরী স্থান পেয়েছে। এতে ভূট্টো লিখেছেন, “সত্তুরের নির্বাচনের আগে শেখ মুজিব তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরদের বলতেন, ‘আমার একমাত্র স্বপ্ন হচ্ছে একটি মুক্ত বাংলাদেশ অর্জন করা। নির্বাচনের পরে আমি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার ধ্বংস করে ফেলব।”
ভূট্টো তাঁর ডাইরীতে আরও লিখেছেন, “১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যদি কোনো তৎপরতা না চালাত, তাহলে শেখ মুজিব পরের দিন (২৬ মার্চ ১৯৭১) স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন।” প্রফেসর উলপার্ট ভূট্টোর ডাইরীর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে অয়ারলেসের মাধ্যমে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।
ছয় দফার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অনমনীয় মনোভাব জুলফিকার আলী ভূট্টো এবং ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ভালো চোখে দেখেন নাই। ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের আহ্বান জানানোর পরিবর্তে গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা পাকিস্তানের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দেয়। এই ঘোষণার প্রতিবাদে প্রথমে অসহযোগ আন্দোলন এবং পরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তিনি যে ভাষণ দান করেন তা’ ছিল প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের চূড়ান্ত পরীক্ষা। কয়েক লক্ষ স্বাধীনতাপ্রেমী জনতা মুক্তিযুদ্ধে তাদের নেতার আদেশ শোনার জন্য রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সমবেত হয়েছিল। তাঁকে ফাঁদে ফেলার এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দমনের জন্য পাকিস্তান সামরিক জান্তা জনতাকে গুলি করে শেষ করার জন্য অপেক্ষা করেছিল। বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠে তবে হিসেব করা নিয়ন্ত্রিত ভাষায় কথা বলছিলেন।
এরপর যখন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঘুমন্ত বাঙালিদের উপর পাকিস্তানী বাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে সেই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। অবশেষে ত্রিশ লাখ বাঙালির তাজা প্রাণ, আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জত এবং প্রায় তের হাজার ভারতীয় সৈন্যের আত্মদানের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আবির্ভূত হয়।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে। তবে হত্যা করে স্বাধীনতার চেতনাকে ধ্বংস করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষের মনে স্বাধীনতা ও মুক্তির অবিনাশী চেতনা সঞ্চারিত করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অনন্য অবদানের কারণেই তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বঙ্গবন্ধু বলতেন “ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার দেশ।” এটি ছিল বঙ্গবন্ধু কর্তৃক দেয়া তাঁর নিজের পরিচয়। কিন্তু বিদেশীরা কী বলেছেন তাঁর সম্পর্কে? সাংবাদিক সিরিল ডান বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, “In the thousand-year history of Bangladesh, Sheikh Mujib is the only
leader who has, in terms of blood, race, language, culture and birth, been full-blooded Bengali. His physical stature was immense. His voice was redolent of thunder. His charisma worked magic on people. The courage and charm that flowed from him made him a superman in these time”.
অর্থাৎ ‘বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিব হলেন একমাত্র নেতা যিনি রক্ত, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি এবং জন্মগতভাবে একজন পরিপূর্ণ বাঙালি। তাঁর শারীরিক গুণমান ছিল বিশাল। তাঁর কণ্ঠস্বর বজ্রের স্মৃতিসুরভিত। তাঁর প্রেরণাসঞ্চারী শক্তি জনগণের ওপর যাদুর মত কাজ করত। সাহস ও আকর্ষণীয়তা যা তাঁর থেকে প্রবাহিত হত তা তাঁকে একজন অতিমানবে পরিণত করেছিল।’
এই সাথে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আর একজন বিদেশীর বর্ণনা আমরা উপস্থাপন করতে পারি। ভারতের মনিপুর এবং ঝাড়খন্ডের সাবেক গভর্নর বেদ মারওয়া বঙ্গবন্ধুর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বর্ণনা করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেদ মারওয়া লন্ডনস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সচিব ছিলেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাবার পর বঙ্গবন্ধু প্রথমে লন্ডনে গিয়েছিলেন। ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ বেদ মারওয়াকে বঙ্গবন্ধুর সাথে বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লী পর্যন্ত যেতে বলেছিলেন । মারওয়া কখনোই চিন্তা করতে পারেন নাই যে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভ্রমণে তিনি (মারওয়া) একজন সাথী হবেন। বিমানে মাত্র পঁচজন যাত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া সেখানে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী, ব্যানার্জী নামের ভারতীয় হাইকমিশনের একজন এটাসে, এবং মারওয়া নিজে।
মারওয়ার এই স্মৃতিচারণ স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৩৫তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে প্রকাশিত “My memories with Bangabandhu” শীর্ষক লেখায়। লন্ডন থেকে যাত্রা শুরুর পর বিমানের মধ্যে যেসব ঘটনা হয়েছিল তার বর্ণনা দিতে গিয়ে মারওয়া বলেন, ‘প্রায় একঘন্টা পর তিনি (বঙ্গবন্ধু) আমার আসনের দিকে এগিয়ে আসলেন। আমি সম্মানের সাথে নিজেকে তাঁর সাথে পরিচিত করলাম। তিনি খুব অনানুষ্ঠানিক রীতিতে অত্যন্ত সহজভাবে আমার সাথে কথা বললেন। এই সংক্ষিপ্ত কথাবার্তার মধ্যেই তিনি বুঝতে পারলেন যে আমি বাংলায় কথা বলতে পারি। এতে তিনি এত আনন্দিত হলেন যে তিনি আমাকে তাঁর পাশে বসতে বললেন। পরের ঘন্টা বা এরকম সময়ের জন্য আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর পাশে বসার।’
মারওয়া বলছেন, ‘তাঁর উষ্ণ এবং স্নেহপরায়ন ব্যক্তিত্ব সোজা কথায় আমাকে অভিভূত করেছিল। তিনি সব বিষয়ে কথা বলছিলেন। আমি ছিলাম একজন মুগ্ধ শ্রোতা। এই সেই মানুষটি পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় ভূট্টো অধিষ্ঠিত না হলে যাকে মেরে ফেলা হতো। এতকিছু সত্ত্বেও তিনি কারও বিরুদ্ধে কোনো বিদ্বেষভাব পোষণ করেন নাই। তিনি শুধু বাংলাদেশের জনগণ ও তাদের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছিলেন। তিনি তাদেরকে ‘আমার জনগণ’ বলে সম্বোধন করছিলেন। ‘দিল্লী বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি যখন অবতরণ করে’, বেদ মারওয়া বলছেন, ‘তখন বিমানবন্দরটি একটি উৎসবমুখর আকৃতি ধারণ করেছিল।’
‘প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বিমানবন্দরে এসেছেন। প্রকৃতিগতভাবে তিনি (শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী) কিছুটা চাপা স্বভাবের। কিন্তু দিল্লী বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর এই অনুষ্ঠানটি একটু ব্যতিক্রম। আমি (এর আগে) কখনো তাঁর মুখমন্ডলে এত বড় হাসি আর দেখিনি। তিনি যুবতী মেয়েদের মতন হাসছিলেন এবং ছোটাছুটি করছিলেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে মুহূর্তের মধ্যে একটি ব্যক্তিগত যোগাযোগ লক্ষ করা গেল।’
মারওয়া এরপর লিখছেন, ‘দিল্লী পর্যন্তই আমাকে আসতে বলা হয়েছিল। বিদায় নেয়ার জন্য আমি যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আমি কেন চলে যাচ্ছি (?) এবং ‘আমি কি ঢাকা পর্যন্ত যেতে চাচ্ছি না?’। ‘যখন আমি তাঁর কাছে বললাম যে আমার সরকার আমাকে বলেছেন তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) সাথে নতুন দিল্লী পর্যন্তই কেবল আসতে, তিনি সাথে সাথে বললেন এরপর থেকে ঢাকা পর্যন্ত আপনি আমার মেহমান।’
সাবেক এই গভর্নর বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে একজন উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ এবং পরে একজন মহান নেতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এরপরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডন সফরে যান তখন মারওয়ার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সেবার লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু ক্লারিজেস হোটেলে ছিলেন। মারওয়া বলছেন, ‘আমি এবং আমার স্ত্রী খুশীতে অবাক হয়ে গেলাম যখন বঙ্গবন্ধু ক্লারিজেস হোটেলে আমাদেরকে চায়ের নিমন্ত্রণ দিলেন। আমি মনে করেছিলাম এটি একটি বড় টি-পার্টি হতে পারে কিন্তু আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম বঙ্গবন্ধু শুধু আমাকে এবং আমার স্ত্রীকেই নিমন্ত্রণ দিয়েছেন এই চায়ের জন্য।’ ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) আমাকে ভুলে যাননি এবং আমার প্রতি তাঁর স্নেহমাখানো সৌজন্যবোধের পরিচায়ক এই চায়ের নিমন্ত্রণ। আমি ভারতীয় হাইকমিশনের একজন নিম্নপদস্থ ফার্স্ট সেক্রেটারী, তাঁর মতন উচ্চ মর্যাদার রাষ্ট্রনায়ক ও মহান নেতার একটি নিমন্ত্রণ! সংক্ষেপে এটাই তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা।’
মারওয়া বলছেন, ‘আমার কাছে তিনি তাঁর সময়ের বিশ্বের সব রাজনৈতিক নেতার চেয়ে অনেক বড় ছিলেন।’ এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একজন বিদেশীর অভিজ্ঞতা। মহত্ত্ব দিয়ে, ঔদার্য দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে, বাঙালিদের তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। বাংলাদেশ তথা বাঙালিদের বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন তিনি দেখতেন। তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর চেতনা বাস্তবায়িত করার জন্যই তিনি ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ শত্রুর মোকাবেলা করার ডাক তিনি দিয়েছিলেন।
হায়! এদেশের কিছু বিপথগামী লোক, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল! অকৃতজ্ঞ জাতি! এই হত্যাকান্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের নেতৃত্ব শূন্য করে দিয়ে পাকিস্তানের স্টাইলে দেশ পরিচালিত করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী চেতনার ধারা যতদিন এ দেশে বইতে থাকবে ততদিন স্বাধীনতা ও মুক্তির চিরন্তন পথ থেকে বাঙালিদের কেউ সরাতে পারবে না। এই শাশ্বত ও চিরন্তন চেতনা বঙ্গবন্ধু নিজে তাঁর মাতা-পিতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ থেকে লাভ করেছিলেন। তাই তিনি তাঁর পরিণত বয়সে দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির জন্য প্রবাহিত করেছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যক্তিত্ব তত্ত্ব ও সামাজিকীকরণ তত্ত্ব অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বকে এভাবেই বিশ্লেষণ করা সম্ভব। বাংলাদেশের গবেষকগণ বিশেষত: যারা জীবনের কোনো এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসেছিলেন বা বঙ্গবন্ধুর স্পর্শ পেয়েছিলেন তাঁরা এই ধরনের একাডেমিক প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসবেন বলে আশা করা যায়।
তথ্য সূত্র:
Bangabandhu most charismatic personality, Says former Indian governor.
The Daily Star, August 17, 2010.
https://www.thedailystar.net/news-detail-151042
Also see Karim, M Shafiqul. Bangabandhu was the most charismatic personality I had met: Ved Marwah. The Daily Observer, January 12, 2016.
https://www.observerbd.com/2016/01/12/130567.php
Elovitaz, Paul H. The Making of Psychohistory: Origins,
Controverseries, and Pioneering Contributors. London: Routledge, 2018.
Wolpert Stanley. Zulfi Bhutto of Pakistan: His Life and Times, USA: Oxford University Press,1993.
প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং আহ্বায়ক, বংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদ।