অভিমত

বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা : বাঙালি জাতির ম্যাগনাকার্টা

তাপস হালদার :

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝেছিলেন, এই রাষ্ট্রটি বাঙালির জন্য তৈরি হয়নি। একদিন বাঙালিকেই এই রাষ্ট্রের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে বাঙালির সীমাহীন বঞ্চনার শিকার হতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা কোনো রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতে পারেনি। প্রশাসনে ভালো পদে কোনো বাঙালিকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। নানা অযৌক্তিক অজুহাত দেখিয়ে সেনাবাহিনীতেও বাঙালিদের দেয়া হয়নি নিয়োগ। বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। কিন্তু প্রায় সমুদয় অর্থ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য। সব ক্ষেত্রেই বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ, বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে এক জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ৬ দফা উত্থাপন করেন। পরের দিন সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে যাতে এটি স্থান পায়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এই ৬-দফা দাবিকে আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে না রেখে বরং প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরেই সাংবাদিক সন্মেলনে ৬-দফা উত্থাপন করেন। এর পর পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে চিহ্নিত করা হয়। ১১ মার্চ ঢাকায় ফিরে তিনি বিমানবন্দরে আবারও সাংবাদিকদের কাছে ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু ১৩ মার্চ ৬-দফাকে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে পাস করিয়ে নিয়ে দলীয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন।

৬-দফা বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার ফসল। দীর্ঘদিন তিনি যে অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করছেন সেই চিন্তা ভাবনা থেকে তিনি ৬-দফা প্রণয়ন করেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ৬-দফা প্রণয়নের ক্ষেত্রে।

৬-দফার দাবিসমূহ নিম্নরূপ:

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।

২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থা সম্বলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে।

৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে।

৫. দুই অংশের মধ্যে দেশীয় পণ্য বিনিময়ে কোনো শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যেকোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।

৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌ-বাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।

৬-দফা দেয়ার পরই পাকিস্তানী শাসকচক্র বুঝতে পেরেছিল, বাংলার মানুষকে সহজে দাবিয়ে রাখা যাবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের আত্মঅধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করবেই। সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধুকেই পাকিস্তানের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তারা জানে বঙ্গবন্ধু আপসহীন। বাঙালি জাতির স্বার্থে তিনি কখনো আপস করেননি, ভবিষ্যতেও করবেন না। পাকিস্তানিরা বলেছিল, ছয় দফার জবাব দেয়া হবে অস্ত্রের ভাষায়। এ অস্ত্রের ভাষায়ই তারা জবাব দিয়েছিল। কিন্তু জনগণের আন্দোলনের কাছে পাকিস্তানী শাসকচক্রকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল।

৬-দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুর ওপর নেমে আসে অত্যাচার, জুলুম ও নির্যাতন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬-দফা অচিরেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করতে দেখে তৎকালীন আইয়ুব সরকার চিন্তায় পড়ে যায়। ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের এক সমাবেশে ‘আপত্তিজনক বক্তব্য’ দেয়ার অজুহাতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রতিরক্ষা আইনে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির আরও অনেক নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। ৬ -দফার সমর্থনে ও বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ আয়োজিত পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে ৭ জুন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

হরতালকে সফল করতে সারাদেশে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। সামরিক শাসকদের ১৪৪ ধারা জারি, নির্যাতন, গ্রেফতার ও গুলিবর্ষণকে উপেক্ষা করে দেশব্যাপী ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মজুরসহ সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ ১১ জন শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। সেই থেকে ৭ জুন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে।

৬-দফা যখন জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেতে শুরু করে, ঠিক সেই সময় নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে পাকিস্তানী শাসক গোষ্টী। মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করে এক নম্বর আসামি করা হয়। স্বৈরাচারী শাসকেরা চেয়েছিল, ওই মামলা দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে নিঃশেষ করে দিতে। কিন্তু হলো তার উল্টো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন।

পরবর্তীতে ৬ দফাকে ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে আন্দোলনে নামেন বাংলার ছাত্রসমাজ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খান বিদায় নেন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

৬-দফা হলো বাংলার মুক্তির সনদ বা ‘ম্যাগনা কার্টা’। ইংল্যান্ডের একটি চুক্তি হলো ম্যাগনা কার্টা, যা ১২১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয়। এটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে একে বর্তমান সাংবিধানিক শাসনের সূচনা বলা হয়। বিশেষ করে রাজা জনের স্বৈরাচারমূলক কাজের জন্য জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে রাজার ক্ষমতা কমানোর জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। জনগণের চাপে পড়ে ইংল্যান্ডের রাজা জন ‘রাজার অধিকার সংক্রান্ত’ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। যার কারণে ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে ম্যাগনাকার্টা সনদ প্রণীত হয়। এই চুক্তির কারণে রাজাকেও নিয়মের মধ্যে আসতে হয়েছিল। রাজনৈতিক ইতিহাসে ম্যাগনা কার্টা সনদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ এর শর্তগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, রাজা প্রতিনিধি স্থানীয় লোকদের অনুমোদন ছাড়া কারো স্বাধীনতায় বা সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। এই চুক্তির প্রভাব সমগ্র পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ে। স্বৈরাচারী রাজা সহজেই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে চাননি। কিন্তু জনগণ মিলে রাজা জন কে লন্ডনের কাছে এক দ্বীপে বন্দি করে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। এই চুক্তি বিচার বিভাগকেও অনেকটা নিরপেক্ষ করছিল। ইংল্যান্ডের সংবিধান বলতে নির্দিষ্ট কোনো দলিল নেই। এই দলিলটি সে দেশের অন্যতম সাংবিধানিক দলিল। প্রজাদের অধিকার ও রাজার ক্ষমতা হ্রাসের যৌক্তিক এ দলিল পরবর্তীকালে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহুদেশে মানবাধিকার ও জনগণের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে।

ঠিক তেমনি ৬-দফার আন্দোলন স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারকেও পরাজয়ে বাধ্য করেছিল। আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল এবং জয়ী হয়েছিল দেশের জনগণ। ৭ জুন বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। স্বাধিকারের দাবিতে এই দিনের শহীদের রক্ত দান ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। স্বাধিকারের এই আন্দোলনই পরবর্তীতে ধাপে ধাপে শত বাঁধাকে পেরিয়ে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শেষ হয়েছিল। অর্জিত হয়েছিল একটি লাল-সবুজের পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *