প্রচ্ছদ

বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণের ৪৭ বর্ষপূর্তি

জাফর ওয়াজেদ  
বাঙালির ইতিহাসের নতুন স্রষ্টা ও পরিপূর্ণতাদানকারী বঙ্গবন্ধু এরপর ভাষণে তুলে ধরেন বাঙালি জাতির সংগ্রামী চেতনার সফল সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু অভিনন্দন জানান
‘নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটছে। নিজেদের শক্তির ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবং সুন্দর ভাবীকালের জন্য আমাদের নিজেদের গড়ে তোলার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা এগিয়ে যাব।’ ৪৭ বছর আগে জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন এই শব্দাবলি। কেমন ছিল সেদিন?
লাল-সবুজের রক্তমাখা পতাকা পতপত করে উড়ছে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে। আরো শতাধিক দেশের পতাকার পাশে বাংলাদেশ ঠাঁই করে নিয়েছে নিজের আসন।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশন। অধিবেশনকক্ষে সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়ক ও সরকারপ্রধানরা। সভাপতি ‘বাঙালি জাতির মহান নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করে বক্তৃতামঞ্চে আহ্বান করেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু সদর্পে বীরোচিত ভঙ্গিমায় আরোহণ করলেন বক্তৃতামঞ্চে। দৃপ্তপায়ে বক্তৃতামঞ্চে উঠে ডায়াসের সামনে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। মুহুর্মুহু করতালি। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করেন মাতৃভাষা বাংলায়। যে ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে বাঙালি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। সেই ভাষায় প্রথম ভাষণ জাতিসংঘে। আর এরই মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে আবার ঠাঁই করে দিলেন। এর আগে ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী জেনেছিল বাংলা ভাষার অমর আবেদন। এর ষাট বছর পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে উচ্চারণ করলেন বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার অমর শব্দসমূহ।
বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে একপলকে চারদিক দেখে নিলেন বঙ্গবন্ধু। এর আট দিন আগে ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য দেশ হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। ওই দিনই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকক্ষে বাঙালির প্রথম প্রবেশ ঘটে। বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ স্থায়ী আসন পেল। বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যভুক্তির পর বিশ্বের অনেক দেশই অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখে। জাতিসংঘে মার্কিন স্থায়ী রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘বিশ্বের পার্লামেন্টে নতুন দেশ বাংলাদেশকে স্বাগত।’ জাতিসংঘের মহাসচিব তখন ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম। তিনিও বাংলাদেশকে স্বাগত জানান, তবে প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাকব মালিক ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং। তাঁরা তাঁদের বক্তব্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। সবার অভিনন্দনের জবাবে বাংলাদেশের পক্ষে বিবৃতি পাঠ করেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্য পদ লাভের ঘোষণায় সেদিন রাজধানী ঢাকায় শত শত আনন্দ মিছিল আর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে যে দীর্ঘ র‌্যালিটি বের হয়, তাতে বাংলাদেশের পতাকা হাতে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তোলার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ঢাকা কলেজের ছাত্র হলেও তাতে অংশগ্রহণ করি।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের আট দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু সাধুভাষায় জাতিসংঘে দেওয়া বাংলায় ভাষণের প্রারম্ভেই বললেন, ‘মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’
বাঙালির ইতিহাসের নতুন স্রষ্টা ও পরিপূর্ণতাদানকারী বঙ্গবন্ধু এরপর ভাষণে তুলে ধরেন বাঙালি জাতির সংগ্রামী চেতনার সফল সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু অভিনন্দন জানান। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামে সমর্থনদানকারী দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধু জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশে দেশে সেনাবাহিনী ব্যবহারের তীব্র নিন্দা জানান এবং বাংলাদেশসহ চারটি দেশ—আলজেরিয়া, গিনি বিসাউ এবং ভিয়েতনামের নামোল্লেখ করে বলেন, ‘এই দেশগুলো অপশক্তির বিরুদ্ধে বিরাট বিজয় অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে।’ ‘চূড়ান্ত বিজয়ের ইতিহাস জনগণের পক্ষেই থাকে’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিন, জাম্বিয়া, নামিবিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তখন দারিদ্র্য, বন্যা, ফসলহানি, ক্ষুধা, মন্দা, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, গুপ্তহত্যা চলছিল। বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু তাঁর পুরো ভাষণে একটিমাত্র দেশের সরকারপ্রধানের নামোল্লেখ করেন। কৃতজ্ঞতাসহকারে বঙ্গবন্ধু তাঁর বন্ধু আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিনের নামোল্লেখ করে বলেন, ‘জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহ যাহাতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় প্রেসিডেন্ট বুমেদিন তাহার জন্যে বিশেষ আহ্বান জানাইয়াছিলেন।’ গুটিকয়েক মানুষের অপ্রত্যাশিত সমৃদ্ধির পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা এর যুক্তিসংগত সমাধান দাবি করে বলেন, অন্যথায় সমগ্র বিশ্বে মহাবিপর্যয় আসন্ন। বঙ্গবন্ধু বার্মাসহ (মিয়ানমার) আঞ্চলিক ‘জোন’ গঠনের সম্ভাবনা ও বাস্তবতার প্রতি তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন ভাষণে।
বঙ্গবন্ধুর আবেগ সব বিশ্বনেতার কাছে তাঁর মহৎ চেতনাকেই প্রকাশিত করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের যুদ্ধের ক্ষত মুছে ফেলতে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষ পর্যায়ে বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘সম্মানিত সভাপতি, মানুষের অজয় শক্তির প্রতি আমার বিশ্বাস রহিয়াছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ অসম্ভবকে জয় করিবার ক্ষমতা রাখে।’ বঙ্গবন্ধু উদাত্ত ভরাট কণ্ঠে বললেন, ‘অজয়কে জয় করিবার সেই শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়াই আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিব।’ এরপর তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো যেই সব দেশ দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, কেবল তাহাদেরই এই দৃঢ়তা ও মনোবল রহিয়াছে। মনে রাখিবেন সভাপতি, আমার বাঙালি জাতি চরম দুঃখ ভোগ করিতে পারে; কিন্তু মরিবে না, টিকিয়া থাকিবার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমার জনগণের দৃঢ়তাই আমাদের প্রধান শক্তি।’
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা যখন জাতিসংঘে ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন সারা বাংলাদেশ গর্বিত হয়ে উঠেছিল সেদিন। যুদ্ধবিধ্বস্ত, অভাব, দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের ভেতরও বাঙালি চিত্ত গৌরবের অংশীদার হয়ে উঠেছিল। স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব, জাতিসংঘে বিশ্বের নানা ভাষাভাষী ও জাতিগোষ্ঠীর সামনে বাংলা ভাষায় বাঙালির প্রথম ভাষণ দিলেন। বাঙালি যেন জগৎসভায় ঠাঁই পেল। বাংলা ভাষায় পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। যে ভাষণে তিনি তাঁর দেশ ও তাঁর জাতির সংগ্রামের ইতিহাস, দৃঢ়তা ও প্রত্যয়ের কথা সবাইকে শুনিয়ে এই জাতিকে সম্মানিত ও গৌরবান্বিত করেছিলেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির একক নাম তখন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরের ২৫ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। আর তাঁরই প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত করেছে জাতিসংঘ। জাতির ইতিহাসে আরেক স্মরণীয় ঘটনা এই উদ্যোগ। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বিশাল অর্জন ও মাহাত্ম্য তুলে ধরেছে। চলতি বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের বাগানে বঙ্গবন্ধুর বেঞ্চ স্থাপন এবং বৃক্ষরোপণ করেছেন।
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণের দিনটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক রাজ্যে প্রতিবছর ২৫ সেপ্টেম্বর পালিত হয়। ‘বাংলাদেশি অভিবাসী দিবস’ বা ‘বাংলাদেশ ইমিগ্র্যান্ড ডে’ হিসেবে পালনের লক্ষ্যে বিল পাস করেছিল স্টেট সিনেট। প্রবাসী বাংলাদেশিদের উত্থাপিত এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে স্টেট সিনেট সর্বসম্মতিক্রমে এই বিল পাস করে। তিন বছর ধরে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিকমহাপরিচালকপ্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *