তাপস হালদার :
১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে শোকাবহ দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। রচিত হয় বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতার কালো অধ্যায়। তাই বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে এক অন্ধকারতম দিনের নাম ১৫ আগস্ট। শুধু বাঙালির ইতিহাস নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম জঘন্যতম ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত দেশের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় তাঁর নিজের বাসভবন বাঙালির রাজনীতির বিদ্যাপীঠ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতেই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে হত্যা করতে সাহস পায়নি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে এদেশীয় কিছু কুলাঙ্গার তাঁকে হত্যার সেই দুঃসাহস দেখিয়েছে। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল।
১৫ আগস্টে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই হত্যা করা হয়নি, নারী-শিশুকেও নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। যুগে যুগে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলের জন্য অনেক রাষ্ট্রনায়ককে হত্যা করা হলেও পরিবারের সকলকে খুঁজে খুঁজে হত্যার নজির ইতিহাসে বিরল। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে যিনি হার মানেননি, যিনি সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন মানুষের জন্য, যাঁকে পাকিস্তানী শত্রুরা খুন করার সাহস পায়নি, সেই রাষ্ট্রনায়ককে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী, শিশু সন্তান, পুত্র-পুত্রবধূসহ নির্মমভাবে হত্যা করেছে এই দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার। যুদ্ধ ক্ষেত্রেও নারী, শিশু, বৃদ্ধকে হত্যা করা যায় না। এটা মানবতা বিরোধী অপরাধ। অথচ ঘাতকরা সেদিন মানবতা বিরোধী অপরাধ করে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত করেছে। পৃথিবীর আর কোথাও এমন বর্বর ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে কেবল রাজনৈতিক পট পরিবর্তনই হয়নি, একই সঙ্গে সূচিত হয়েছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পশ্চাৎমুখী যাত্রা। এটা কেবল একজন রাষ্ট্রনায়কের, ইতিহাসের এক মহানায়কের মৃত্যুই ছিল না, এই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডটি ছিল এক বিজয়ী জাতির সামনের দিকে প্রগতির ধারায় চলার পথকে রূদ্ধ করে দেয়ার।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ঘাতকদের বিচার করা হয়েছে। এটা কোনো স্বস্তির বিষয় নয়। কারণ এখন পর্যন্ত নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ডের মুখোশ উন্মোচন করা যায়নি। সামনে কিছু ঘাতক ও পিছনে খন্দকার মোশতাককে দেখলেই হবে না। এরা ছিল শুধু খেলার পুতুল। জিয়াউর রহমান হলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন জিয়াউর রহমান। ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক হলেন জিয়াউর রহমান আর সহযোগিতা করে পাকিস্তানসহ স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা।
বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল সেই হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়কদের বিচার করা হয়নি। এই ষড়যন্ত্রকারীদের নেপথ্য নায়কদের মুখোশ উন্মোচন করা সবচেয়ে জরুরি।
১৫ আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ-ই প্রমাণ করে জিয়াই ছিলেন অন্যতম পরিকল্পনাকারী। জিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করে খুনিদের বিচারের সম্মুখীন না করে উল্টো তাদের বিচার থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। পাশাপাশি হত্যা-ক্যুয়ের মধ্যদিয়ে ক্ষমতা দখল ও চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যেই জন্ম দেন বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল।
আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ায় ঘাতকদের সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা বারবার উঠে এসেছে। হত্যা পরিকল্পনার কথা যে জিয়াউর রহমান জানতেন এবং তিনি যে ঘাতকদের এগিয়ে যেতে বলেছিলেন, তার অনেক তথ্য-প্রমাণ ঘাতকদের বক্তব্য থেকেই পাওয়া গেছে। ঘাতকদের কেউ কেউ বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের কাছেও এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছে।
জিয়া নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করলেও তিনিই শাসনক্ষমতা হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। পাকিস্তানী এজেন্ট মুক্তিযোদ্ধা জিয়াই বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানানোর পরিকল্পনায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন।
প্রথমেই ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে পাকিস্তানি কায়দায় উর্দু শব্দে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এর প্রচলন করেন। ‘বাংলাদেশ বেতার’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা হয়। সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে একে সাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়া হয়। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরদের পুনর্বাসন করা হয়। নরঘাতক গোলাম আজমকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনে দেয়া হয় নাগরিকত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে করা হয় ভূলুণ্ঠিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। এমনকি জাতীয় সংগীতেরও অবমাননা করা হয় বিভিন্নভাবে। সেসময় অনেক সরকারি অনুষ্ঠানেও জাতীয় সংগীতের পরিবর্তে শুধু সুর বাজানো শুরু হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য অনেক অপচেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া ছিল অপরাধ। ৭ মার্চের ভাষণকেও করা হয়েছিল নিষিদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারকে স্বাধীনতার ঘোষক করার কতোই না বৃথা চেষ্টা করা হয়েছে। দু-যুগেরও বেশি সময় পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃত করে ছাত্র-ছাত্রীদের ভুল শিক্ষা নিতে বাধ্য করা হয়েছে। ১৫ আগস্টের শোক দিবসের দিনে খালেদা জিয়া মিথ্যা জন্মদিন পালন করে জাতির সাথে করেছেন পরিহাস।
মিথ্যা দিয়ে সত্যকে কিছু সময়ের জন্য চাপা দিয়ে রাখলেও সত্য সূর্যের মত আলোকিত হবেই। ২০০৮ সালে সংবিধানের রক্ষক সুপ্রীমকোর্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জাতির পিতা ও শোকাবহ ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেন। এখন এই দুইটি বিষয় আইন দ্বারা স্বীকৃত, চাইলেই কেউ আর মুছে ফেলতে পারবে না।
অন্যদিকে, যে ৭ মার্চের ভাষণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সেই ভাষণ আজ ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। একেই বলে ইতিহাসের প্রতিশোধ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২৮ আগস্ট ১৯৭৫, লন্ডনের খ্যাতনামা পত্রিকা ‘দ্য লিসনার’ মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেছিল,‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও জনগণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে তখন নিঃসন্দেহে বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত তার বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারকচিহ্ন এবং কবরস্থান পূণ্যতীর্থে পরিণত হবে।’ আজ সে কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গীপাড়ার স্মৃতিসৌধ রাজনৈতিক তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। আজ প্রমাণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। কারণ তিনি নিজেই বাঙালির ইতিহাস। যতদিন বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ থাকবে ততদিনই বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তাঁর আদর্শের মৃত্যু নেই। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। কেননা তিনি একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, তিনিই স্থপতি। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের সাথে মিশে আছে তাঁর অস্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটা চেতনা, আদর্শের নাম। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু আদর্শের কখনো মৃত্যু হয় না।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
ইমেইল: haldertapas80@gmail.com