বিএনপির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেও আলোচিত হচ্ছে দলটির নেতৃত্বের দুর্নীতির কথা। ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন ক্যাবলের একটি সিরিজ বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘হিংসাত্মক রাজনীতির প্রতীক’ এই পলাতক ও দণ্ডিত অপরাধী নেতার বিরুদ্ধে অপকর্মের দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। বিএনপি সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিকে হাঁটতে চাইলেও এর পেছনে প্রথম ও প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের শীর্ষ নেতা তারেক রহমান।
বিএনপি-জামায়াত শাসনের পতনের ঠিক পরে উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন ক্যাবলের একটি সিরিজে বলা হয়, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলের কারণে দেশে ঘুস, আত্মসাৎ ও দুর্নীতির সংস্কৃতির অনুকূলে পরিবেশ গড়ে উঠেছে ও সেটি বজায় থাকছে। এটি মার্কিনিদেরও বড় ক্ষতি করেছে।
ফাঁস হওয়া তথ্যে আরও বলা হয়, ‘জনসাধারণের অর্থের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি মধ্যপন্থী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণ্ন করেছে ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করেছে।’ তারেক রহমানকে বাংলাদেশের ‘বিকল্প সরকার ও সহিংস রাজনীতির’ প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর একটি গোপন তারবার্তা পাঠান। যেখানে তিনি তারেকের সুস্পষ্ট দুর্নীতি মার্কিনিদের সুনির্দিষ্ট মিশনের লক্ষ্যকেও মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বার্তায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান অগ্রাধিকার সন্ত্রাসীদের স্থান না দেওয়া।’ এমনটি উল্লেখ করে বার্তায় বলা হয়, সাহসীভাবে তারেকের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগুলিকে বিপন্ন করছে।
মরিয়ার্টি তার প্রতিবেদনে বলেন, ‘তারেকের আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের ইতিহাস আইনের শাসনকে ক্ষুণ্ন করে ও একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মার্কিন লক্ষ্যকে ক্ষুণ্ন করার হুমকি দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারেক যে কলুষিত ব্যবসায়িক চর্চা ও ঘুসের প্ররোচনার পরিবেশ উৎসাহিত করছে তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। সেই সঙ্গে মার্কিন কোম্পানিগুলোর আন্তর্জাতিক ক্রিয়াকলাপকে জটিল করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মার্কিন প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করেছে।’
এ ছাড়া মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) এক তদন্তে জানা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক একটি প্রক্সির মাধ্যমে একটি অংশ পেয়েছিলেন। যেটি কানাডাভিত্তিক নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেডের একটি লিজ পাওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছিল। মূলত, সিলেটের কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রের জন্য এই ঘুস দেওয়া হয়।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১-২০০৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে সন্ত্রাসী সরবরাহ করা হতো বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। সম্প্রতি দেশটির সংবাদ মাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের সঙ্গে আলাপকালে এ মন্তব্য করেন তিনি। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। এখানে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের দুর্নীতি ও তার কারণে সৃষ্ট গণতান্ত্রিক ও নিরাপত্তা সংকটের তথ্যও উঠে আসে।
আবারও সেই দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বকে ফিরিয়ে আনার জন্যই বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে যার প্রমাণ প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশের বক্তব্যে তারা রাখছে। ইন্ডিয়া টুডের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরের বেশি সময় বাকি থাকতেই রাজনৈতিক দৃশ্যপট অস্থির হয়ে উঠেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা বারবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘উৎখাত’ করার আহ্বান জানাচ্ছে। এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিতে ১০ ডিসেম্বর বড় জমায়েত করার ডাক দিয়েছে। সম্প্রতি এক জনসভায় বিএনপির শীর্ষ নেতা আমানুল্লাহ আমান বলেন, ‘আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে জিয়ার (বেগম খালেদা ও তারেক জিয়া) নির্দেশে দেশ পরিচালিত হবে।’
এতে স্পষ্টভাবেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ইসলামী গোষ্ঠীটি যেই বিরোধী জোট গঠন করেছে তা সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে রাজপথে সহিংস আন্দোলন করতে পারে বলে আভাস ফুটে উঠেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে চলমান সংকটকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীলতার জন্য ব্যবহারের উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে। যদিও এসব আন্দোলনের কারণে উৎপাদন ও বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অর্থনীতি ব্যাহত হলে সেটি বরং বিএনপির জন্যই নেতিবাচক হতে পারে বলে মত অনেকের।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় থেকেই বিএনপি ও তার প্রধান মিত্র জামায়াত-ই-ইসলামী ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য নির্বাচন বয়কট করে রাজপথে সহিংসতার পথ বেছে নেয়।
তবে ব্যারাকে জন্ম নেওয়া ও গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের সংস্কৃতিতে অনভ্যস্ত দলটি তার উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত, তারপরে ভয়ংকর সন্ত্রাস, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা, সংখ্যালঘুদের ওপর জামায়াতের সহিংসতাকে বিএনপি-জামায়াত জোটের অন্যতম ‘বড় ভুল’ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এসব আন্দোলনে সে সময় শত শত জন প্রাণ হারিয়েছে ও অসংখ্য আহত হয়েছে।
বিএনপির ডাকে অনুষ্ঠিত কয়েকটি সমাবেশ থেকেই শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা দখলের ডাক দিয়েছেন। সম্প্রতি রাজধানীতে আওয়ামী লীগের যুব মোর্চা যুবলীগ আয়োজিত সমাবেশ মানবসমুদ্রে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এই মানবসমুদ্র দেখাতে ড্রোন ফুটেজ ব্যবহার করেছে। এতে তারা দেখায় ক্ষমতাসীন দলের সমাবেশে ভিড় বিএনপির আয়োজিত সমাবেশের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
অপরদিকে বাংলাদেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর জোর দিয়েছেন ভারতের রাজনীতিক ও লেখকরা। এতে তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও তার সরকারের প্রশংসাও করেছেন তারা। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, ‘আসামে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করার পেছনে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে (২০০১-২০০৬) বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হতো। তবে শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান আসামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনেক সাহায্য করেছে। আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা স্বীকার করি।’
ভারতের প্রথিতযশা লেখক সুবীর ভৌমিক বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ব্যাপক অভিযানের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে সংঘাত ব্যাপকভাবে কমেছে। এ কারণে দিল্লি ওই অঞ্চল থেকে নজর সরিয়ে নিজের সেনা হিমালয় সীমান্তে পাঠাতে পেরেছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকায় পটপরিবর্তনের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান থাকা উচিৎ। কারণ শেখ হাসিনা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে ট্রানজিট সুবিধা ও বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন।’
সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মন্তব্য করেছেন, ‘দেশে কোনো জঙ্গি নেই ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানকে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট নাটক বলে মনে হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে সেখান থেকে কিছু জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর এই বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়। এরইমধ্যে পাহাড়ে অস্থিরতা থামাতে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান চালানোর পর এই অঞ্চলে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সন্ধান মেলে।
ফখরুলের এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ অনেকেই বলছেন, পলাতক নেতা তারেকের কাছ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণায় ফখরুল জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন।
২০০৪ সালের পহেলা এপ্রিল। বিএনপি জামায়াত জোটের শাসনামলের শেষ ভাগ। এ সময় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের চালান উদ্ধার করে পুলিশ। সেগুলো উলফার মতো ভয়ঙ্কর গোষ্ঠীর জন্য আনা হয়েছিল। ভারতের আসাম সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর জন্য ভয়ংকর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য এই দশ ট্রাক অস্ত্র সরবরাহের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পোর্টে আসে যা জব্দ করে পুলিশ। এই মামলায় আদালতের রায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক ও তার সহযোগী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফর জামান বাবরের ভূমিকা উঠে এসেছে।
বার্টিল লিন্টনারের মতো বিখ্যাত বিশ্লেষক বাংলাদেশকে সেই সময়কে ‘সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তৎকালীন সরকারের কার্যক্রমের কারণে এলিসা গ্রিসওল্ড এই দেশে আফগান স্টাইলের ইসলামি বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এমনকি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত সরকারের পূর্ববর্তী মেয়াদে জঙ্গিদের সুস্পষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা দিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘শেখ হাসিনাকে স্পষ্টতই জঙ্গি বিরোধী কার্যক্রমে তার দৃঢ় সংকল্পের জন্য যথাযথ কৃতিত্ব দেওয়া উচিত। একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশের জন্য তার কারণেই জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে।’ বাংলাদেশের এই বিষয়টিকেই অনেকে ‘মানব উন্নয়নের মডেল’ হিসেবে বর্ণনা করেন।