লাইফস্টাইল ডেস্ক, ধূমকেতু বাংলা: প্রিন্সেস ডায়ানাকে বলা হয় বিংশ শতাব্দীর ফ্যাশন আইকন। রূপকথার রাজকুমারীর মতোই ঘটনাবহুল প্রিন্সেস ডায়ানার (যদিও উনি আসলে প্রিন্সেস নন, তবে এই নামেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত) জীবন। ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছেলে প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে বিয়ে, চোখধাঁধানো ফ্যাশন, মানবকল্যাণমূলক বিভিন্ন কার্যক্রম, প্রেম আর শেষে ‘রহস্যময়’ মৃত্যু—সব মিলিয়ে তিনি সব সময়ই ছিলেন গণমাধ্যম ও মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে। বিশ্ব ফ্যাশনের আলোচনা এলে প্রিন্সেস ডায়ানাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং ফ্যাশনের দুনিয়ায় আজও প্রাসঙ্গিক ডায়ানা।
ফ্যাশনের জগতে এখনো অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন প্রিন্সেস ডায়ানা। তৎকালীন ফ্যাশনের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্টাইলের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ছিলেন ফ্যাশন দুনিয়ার সবার নজরে। ফ্যাশনেবল পোশাকের কারণে তার সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলেন ডায়ানা। বিশেষ করে সিল্কের রিভেঞ্জ ড্রেস, ট্রাভোল্টা ড্রেস এবং ডেভিড ও এলিজাবেথ এমানুয়েলের নকশা করা বিয়ের পোশাক তাকে ফ্যাশনের জগতে সব সময় উজ্জ্বল করে রেখেছে। প্রিন্সেস ডায়ানার পছন্দের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে এই লেখা।
ক্যাথেরিন ওয়াকার বানিয়েছিল ডায়ানার এলভিস গাউন
ফ্রান্সের বংশোদ্ভূত লন্ডনের ডিজাইনার ক্যাথেরিন ওয়াকার ও তার স্বামী সাইরাস ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ফ্যাশন হাউস ক্যাথেরিন ওয়াকার অ্যান্ড কোম্পানি। প্রিন্সেস ডায়ানার পছন্দের শীর্ষের দিকে ছিল এই ফ্যাশন হাউসের পোশাক। ১৯৮১ সালে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছেলে প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে বিয়ের পর প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানার সঙ্গে ডিজাইনার ক্যাথেরিন ওয়াকারের ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অটুট ছিল। এই সময়ে ক্যাথেরিন ওয়াকার অ্যান্ড কোম্পানি ডায়ানার জন্য এলভিস গাউনসহ আইকনিক পোশাকগুলো তৈরি করে দিয়েছিল। প্রিন্সেস ডায়ানার পছন্দের মুক্তাখচিত পোশাকটিও ওয়াকার অ্যান্ড কোম্পানির নকশা করা ছিল। ১৯৯১ সালে ব্রাজিল সফরের সময় তিনি ওই পোশাক পরেছিলেন। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে ফ্যাশন ব্র্যান্ড ওয়াকার অ্যান্ড কোম্পানি ডায়ানার বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়ামের স্ত্রী ডাচেস অব কেমব্রিজ কেট মিডলটনেরও পছন্দের শীর্ষে রয়েছে।
ডিওরের পোশাক ও প্রসাধনী প্রিয় ছিল ডায়ানারও
প্রিন্সেস ডায়ানা অভিজাত ফরাসি ফ্যাশন ব্র্যান্ড ডিওরের পোশাক ও প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহার করতেন। ১৯৪৬ সালে ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান ডিওর অভিজাত এই ফ্যাশন হাউস প্রতিষ্ঠা করেন। ফ্যাশন ব্র্যান্ড ডিওর এখনো ফ্যাশনের জগতে সমান জনপ্রিয়।
জিয়ান্নি ভার্সেস ছিলেন ডায়ানার বন্ধু
ইতালির জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড জিয়ান্নি ভার্সেসের বিরাট ফ্যান ছিলেন প্রিন্সেস ডায়ানা। শুধু তা-ই নয়, ডায়ানা ভার্সেসের প্রতিষ্ঠাতা ও ডিজাইনার জিয়ান্নি ভার্সেসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানার মৃত্যু ঘটে সড়ক দুর্ঘটনায়। এর কিছুদিন আগে মৃত্যু হয় বন্ধু জিয়ান্নি ভার্সেসের। তার মৃত্যুতে ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন ডায়ানা। নব্বই দশকে জিয়ান্নি ভার্সেসের নকশা করা অসংখ্য পোশাক ও প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহার করেছেন ডায়ানা। ১৯৯৬ সালে সিডনি সফরের সময় ভার্সেসের নকশা করা এক কাঁধ খোলা সিল্কের নীল রঙের গাউন পরেছিলেন ডায়ানা।
ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার ব্রুস ওল্ডফিল্ড। তার নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ব্র্যান্ড ব্রুস ওল্ডফিল্ডের পোশাক কুইন নুর অব জর্ডান, ডাচেস অব কর্নওয়াল ক্যামিলা, জর্ডানের রানি রানিয়া ছাড়াও ব্যবহার করেছেন প্রিন্সেস ডায়ানা। সে সময় ব্রুস ওল্ডফিল্ড মূলত কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে পোশাক তৈরি করত। ডায়ানা আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে নব্বই দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ব্রুস ওল্ডফিল্ডের নকশা করা পোশাক পরেছেন। পরে ডায়ানা নিজের ফ্যাশন স্টাইল পরিবর্তন করে ফেলেন। সে সময় তিনি ব্রুস ওল্ডফিল্ডের পোশাক পরা ছেড়ে দেন। পরে তার ব্যবহার করা ব্রুস ওল্ডফিল্ডের পোশাকগুলো নিলামকারী প্রতিষ্ঠান ‘ক্রিস্টিস’-এর মাধ্যমে নিলাম হয়ে যায়। আশির দশকে ডায়ানার পরা ব্রুস ওল্ডফিল্ডের একটা ভেলভেট গাউন ৪৫ হাজার পাউন্ডে (মানে, সেই সময়ে ৫২ লাখ ৪২ হাজার টাকায়) নিলামে বিক্রি হয়ে যায়।
বেলভিলে সাসুনের গোলাপি গাউন তো বিখ্যাত
জনপ্রিয় ব্রিটিশ ফ্যাশন ব্র্যান্ড বেলভিলে সাসুনের প্রতিষ্ঠা ১৯৫৩ সালে। কিন্তু ১৯৭০ সালের পর ডেভিড সাসুন নতুন করে এই ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তী ২০ বছর তিনি প্রিন্সেস ডায়ানার জন্য কমপক্ষে ৭০টি গাউন নিজের নকশায় তৈরি করেছিলেন। ১৯৮২ সালে প্রিন্স উইলিয়ামকে কোলে নিয়ে তোলা ছবিটি অনেকের পরিচিত। ওই দিন তার পরনে থাকা গোলাপি রঙের ফুলেল পোশাকটি বেলভিলে সাসুনের তৈরি।
ডায়ানার বিয়ের গাউন এমানুয়েলের তৈরি
প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানার রাজকীয় বিয়ের পোশাক তৈরি করেছিলেন ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার ডেভিড ও এলিজাবেথ এমানুয়েল। ডায়ানার বিয়ের জমকালো এই পোশাক আইভরি সিল্ক ও অ্যান্টিক লেইসে ১০ হাজার মুক্তা এবং ভিনিসীয় স্বর্ণমুদ্রা বসিয়ে তৈরি করা হয়েছিল।
ফেরাগামোর হাতব্যাগ
প্রিন্সেস ডায়ানা ইতালিয়ান ব্র্যান্ড সালভাতোর ফেরাগামোর হাতব্যাগের খুব ভক্ত ছিলেন।
ট্রাভোল্টা ড্রেস!
ব্রিটিশ ডিজাইনার ভিক্টর এডেলস্টেইনের তৈরি পোশাক পছন্দ করতেন প্রিন্সেস ডায়ানা। ডায়ানার জন্য এডেলস্টেইনের তৈরি একটি পোশাকের নাম ট্রাভোল্টা ড্রেস। এই পোশাক শুধু ডায়ানাই পরেছিলেন। ১৯৮৫ সালে হোয়াইট হাউসে প্রথমবারের মতো একটি গালা ডিনারে অংশ নিয়ে ওই পোশাক পরেছিলেন ডায়ানা। সেই রাতে হোয়াইট হাউসে ওই পোশাক পরা ডায়ানার সঙ্গে মার্কিন অভিনেতা জন ট্রাভোল্টা নেচেছিলেন। পরে ওই পোশাকের নাম রাখা হয় ট্রাভোল্টা ড্রেস।
এক নজরে ডায়ানার জীবন
১৯৮১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাগদানের খবর জনসমক্ষে প্রকাশ করেন চার্লস ও ফ্যাশন সচেতন ডায়ানা। ওই বছরের ২৯ জুলাই ২০ বছর বয়সী ডায়ানা ৩২ বছর বয়সী চার্লসের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮২ সালের ২১ জুন প্রথম সন্তান প্রিন্স উইলিয়ামের জন্ম। ১৯৮৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্ম হয় প্রিন্স হ্যারির। ১৯৯৬ সালে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডায়ানার সঙ্গে প্রিন্স চার্লসের বৈবাহিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
একটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে ডায়ানা-দোদি ১৯৯৭ সালের ৩০ আগস্ট বেলা ১টায় সার্ডিনিয়া থেকে প্যারিসের পথে রওনা হন। বিকেল সাড়ে চারটায় তারা এসে ওঠেন রিটজ হোটেলে। হোটেলটির মালিক দোদির বাবা, মিসরীয় ধনকুবের মোহাম্মদ আল-ফায়েদ। পাপারাজ্জিরা পিছু নিতে পারে, এই সন্দেহে তারা পেছনের দরজা দিয়ে হোটেলে ঢোকেন, ইম্পিরিয়াল স্যুটে ওঠেন। রিটজ হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে রাত ১২টা ২০ মিনিটে (ততক্ষণে দিন গড়িয়ে চলে এসেছে ৩১ আগস্ট) ডায়ানা-দোদি বেরিয়ে আসেন। একটি কালো মার্সেডিস অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। চালক ছিলেন রিটজ হোটেলের কর্মচারী হেনরি পল। দেহরক্ষী ট্রেভর রিস জোনস বসেছিলেন চালকের পাশে সামনের আসনে। পাপারাজ্জিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য গাড়িটি প্রচণ্ড বেগে চলতে শুরু করে এবং একটি টানেলের মধ্যে কংক্রিট পিলারের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় গাড়িটির। দুমড়েমুচড়ে যায় মার্সেডিস। ঘটনাস্থলেই দোদি আর পল মারা যান। ওখানেই ডায়ানার প্রাথমিক শুশ্রূষার পর রাত ১টা ২০ মিনিটে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তার দেহে অস্ত্রোপচার হয়। ভোর চারটার দিকে চিকিৎসকেরা বিশ শতকের ফ্যাশন আইকন ডায়ানাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সূত্র: সিএনএন, ভোগ, এএফপি, রিডার্স ডাইজেস্ট, মেরিক্লেয়ার ও টাইম সাময়িকী।
আরো পড়ুন: