নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু বাংলা: পুরোনো মোবাইল বা ল্যাপটপ বিক্রি করে খুব বেশি দাম পাওয়া যায় না। এ কারণে নতুন ল্যাপটপ কিনে অনেক সময় আমরা হয়তো পুরোনোটা ফেলেই রাখি ঘরে। ঘরে ফেলে রাখা পুরোনো এসব যন্ত্র ন্যায্যমূল্যে কিনে নেয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘সোয়াপ’। সেসব যন্ত্র ব্যবহারের উপযোগী করে নির্দিষ্ট একটি দাম ধরে আবার অনলাইনে বিক্রিও করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এভাবে যার যন্ত্রটি দরকার নেই, তিনি টাকা পেয়ে যান, যার যন্ত্রটি দরকার, তিনি কম দামে কিনতে পারেন। ফলে অব্যবহৃত যন্ত্রটি পরিবেশদূষণের কারণ হয় না। এভাবে পুরোনো পণ্য কেনাবেচার ব্যবসা করে সফলতা পেয়েছে সোয়াপ। মোবাইল ও ল্যাপটপের পাশাপাশি মোটরসাইকেল ও গাড়িও এভাবে বেচাকেনা করে থাকে সোয়াপ।

মাত্র ২০ মাস বয়সী এ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কাজ করছেন ৬০ জন কর্মী। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার নানা দিক নিয়ে কথা হয় সোয়াপের প্রতিষ্ঠাতা পারভেজ হোসাইনের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটির বনানী কার্যালয়ে গল্পে গল্পে পারভেজ হোসাইন বলেন, মাত্র ২০ মাসে প্রায় ৫০ গুণ বড় হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তাঁরা এখন কাজ করেন স্যামসাং, হুয়াওয়ে, অ্যাপল, বাজাজের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

পারভেজ হোসাইন বলেন, ‘এখন আমরা যা ব্যবসা করছি, তা অতি সামান্য। গত বছরের শেষের দিকে আমরা একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাজার গবেষণা করে দেখেছি, বাংলাদেশে মানুষের বাসাবাড়িতে যে পরিমাণ পুরোনো অব্যবহৃত মোবাইল, ল্যাপটপ বা টেলিভিশন পড়ে আছে, তার অবচয়মূল্য বিবেচনা করলে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য ঘরে পড়ে আছে। অথচ এই পণ্যগুলো বিক্রি করলে টাকাটা অর্থনীতিতে যুক্ত হতো।’

পারভেজের এ ব্যবসায় আসাটাও প্রয়োজনের তাগিদে। তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালে এ ধরনের একটি ব্যবসার পরিকল্পনা আমার মাথায় আসে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র। সে সময় একেকটি ল্যাপটপের দাম ছিল লাখ টাকার ওপরে। শিক্ষার্থীদের এত টাকায় ল্যাপটপ কেনার সামর্থ্য ছিল খুব কম। ওই সময় আমাদের বন্ধুদের অনেকে পাঠদান কক্ষে ল্যাপটপ নিয়ে আসত প্রেজেন্টেশন দেওয়ার জন্য। শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমারও একটি ল্যাপটপের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। তখন আমরা চার বন্ধু মিলে ঠিক করেছিলাম, একটি ল্যাপটপ কিনব। কারণ, একা কেনার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। নতুন কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে পুরোনো ল্যাপটপ কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম। ৪০ হাজার টাকা দামে পুরোনো একটি ল্যাপটপ পেয়েও গেলাম। যদিও শেষ পর্যন্ত টাকার অভাবে সেটিও কেনা হয়নি। তখনই হঠাৎ মনে হলো, মানুষের মধ্যে তো পুরোনো জিনিসের চাহিদা রয়েছে। তাই তখন থেকেই পুরোনো ল্যাপটপ বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি কেনাবেচার একটি ব্যবসা গড়ে তোলার চিন্তা মাথায় আসে।’

সোয়াপের ব্যবসার ধরন সম্পর্কে পারভেজ হোসাইন বলেন, ‘যার ঘরে পণ্য যে অবস্থায় আছে, তেমনি আমরা কিনে নিই। ধরুন, একটি মোবাইল বা ল্যাপটপ একদমই চলছে না, সেটিও আমরা কিনি। এরপর সেটি ভেঙে তার থেকে ব্যবহারের উপযোগী অংশ রেখে নষ্ট অংশ পাঠিয়ে দিই রি-সাইকেলে বা পুনরুৎপাদনে। যেহেতু আমরা পণ্য বিক্রি করে দাম পাই, তাই বিক্রেতাকেও পণ্যের দাম দিই।’

পারভেজ হোসাইন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, প্রযুক্তির জন্য সেই সময়কে স্বর্ণযুগ বলা হতো। প্রতিবছরই মোবাইল ও ল্যাপটপে যুক্ত হচ্ছিল নতুন নতুন ফিচার। এ কারণে নতুন পণ্য কেনার আগ্রহও বাড়ছিল মানুষের। নতুন কিছু কেনা মানেই পুরোনোটির ব্যবহার কমে যাওয়া। ওই সময়ও পুরোনো পণ্য কেনাবেচার হাতে গোনা কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম থাকলেও ব্যক্তিপর্যায়ে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করে পণ্য বিক্রি করত। সেখানেই পরিবর্তন এনে নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখেন পারভেজ হোসাইন।

২০০৬ সালে আইবিএ থেকে স্নাতক পাস করার আগেই পারভেজ হোসাইন রাজধানীর ধানমন্ডির অরচার্ড পয়েন্টে একটি দোকান ভাড়া নেন। ওই দোকানে পুরোনো মোবাইল বিক্রি করা যেত, আবার যাঁর প্রয়োজন, ওই পুরোনো মোবাইল কিনেও নিতে পারতেন। পারভেজ বলেন, ‘ধারণাটা তখন খুবই নতুন ছিল। তাই অনেকের কটু কথা শুনতে হয়েছিল। তবে যাঁদের দরকার ছিল, তাঁরা ঠিক আমাকে খুঁজে নিতেন।’

আইবিএ থেকে স্নাতকোত্তর করে পারভেজ চাকরি নেন বহুজাতিক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানিতে। কিছুদিন কাজ করার পর তাঁর মনে হলো, তাঁর ব্যবসার সম্ভাবনা প্রচুর। এই ব্যবসা চাকরির পাশাপাশি করা যাবে না। তাই চাকরি ছেড়ে মন দেন ব্যবসায়। ‘লাইভওয়্যার’ নামে ইলেকট্রনিকসের পণ্য অদলবদলের স্থায়ী দোকান দেন। সেই দোকানই ভিত গড়ে দিয়েছে আজকের সোয়াপের।

২০১৯ পর্যন্ত বেশ ভালো চলছিল লাইভওয়্যারের ব্যবসা। ঢাকায় একে একে গড়ে তুলেছিলেন সাতটি দোকান। এরপর পারভেজের মনে হলো, ব্যবসাটা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। তিনি বলেন, ‘ধরেন, চুয়াডাঙ্গা বা গাইবান্ধা থেকে একজন যদি পুরোনো যন্ত্র বিক্রি করতে চান, তাহলে তাঁকে ঢাকায় আসতে হবে। আবার সারা দেশে ব্যবসা ছড়িয়ে দেওয়ার মতো বিনিয়োগও করতে পারছিলাম না।’ সারা দেশে ব্যবসাটি ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোয়াপ গড়ে তোলেন।

সোয়াপ তৈরি করতে খরচ হয়েছিল দুই কোটি টাকা। প্রথম মাসে আয় ছিল মাত্র ১৭ লাখ টাকা। পুঁজি কম হলেও পারভেজের মতে, তাঁর মূল পুঁজি ছিল পুরোনো যন্ত্র বিক্রির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। ‘আমরা শুরুই করেছিলাম স্যামসাং মোবাইলের একটি অদলবদলের ক্যাম্পেইন দিয়ে।’ ক্যাম্পেইনের কারণে খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায় সোয়াপ। এরপর হানা দেয় করোনা। করোনা এক অর্থে আশীর্বাদই হয়ে যায় সোয়াপের জন্য। সে সময়ে লেখাপড়া ও অফিসের কাজের জন্য মোবাইল ও ল্যাপটপের চাহিদা দ্বিগুণ-তিন গুণ হয়ে যায়। আবার বিদেশ থেকে আসাও বন্ধ ছিল। ফলে পুরোনো ল্যাপটপ বা পণ্যের প্রতি ক্রেতার চাহিদা তৈরি হয়। সেই চাহিদাকে কাজে লাগান পারভেজ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

পারভেজ বলেন, এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার মানুষের সঙ্গে ব্যবসা করেছে সোয়াপ। প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত গ্রাহক প্রায় পাঁচ লাখ। সোয়াপের অ্যাপ সাড়ে পাঁচ লাখবার ডাউনলোড হয়েছে। প্রথম মাসে মাত্র ১৭ লাখ টাকা আয় হলেও গত নভেম্বর মাসে সোয়াপের আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটি টাকায়। তিনি বলেন, প্রতি মাসে তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিক্রি প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। চলতি বছরের শুরুতে সোয়াপ অংশ নেয় সিঙ্গাপুরে এক্সিলারেটিং এশিয়া প্রতিযোগিতায়। নতুন উদ্যোগ হিসেবে শীর্ষ দশে জায়গা করে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। তাতে দেশ-বিদেশ থেকে ১১ কোটি টাকার বিনিয়োগ পায় সোয়াপ। চলতি বছরের শুরুতে সোয়াপের সম্পদমূল্য ছিল ৫২ কোটি টাকা। বছর শেষে তা শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

পুরোনো মোবাইল ও ল্যাপটপ কেনাবেচার যে ব্যবসা সোয়াপ গড়ে তুলেছে, এখন প্রয়োগ করছে মোটরসাইকেল ও গাড়ির ক্ষেত্রেও।

আরো পড়ুন:

বাজারে আসছে শাওমির ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ রেডমি ৯এ

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *