নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু বাংলা: ভাগ্য বদলাতে গিয়েছিলেন বিদেশে। তাও আবার দু-একটি দেশ নয়, ভাগ্যান্বেষণে ঘুরেছেন তিন-চারটি দেশে। কিন্তু তাতেও শিকে ছেঁড়েনি। অগত্যা ফিরে আসেন নিজ দেশে, নিজ গ্রামে। পুঁজিপাটা যা ছিল তাও প্রায় শেষ। কী করবেন, কীভাবে চলবে—এসব ভাবতে ভাবতেই দিলেন চায়ের স্টল। ছেলের নামে নাম রাখলেন মুন্না টি-স্টল। এতেও ঠিক সুবিধা হচ্ছিল না। সামলাতে পারছিলেন না সংসারের খরচ।
এবার ভিন্ন চিন্তা এলো মাথায়। শীতে তো পিঠার ভালো চাহিদা থাকে। ভাবলেন দোকানের সামনে সকাল-সন্ধ্যা পিঠা বানিয়ে বিক্রি করা যায়। শুরু করলেন পিঠা বানানো। কিন্তু মৌসুমি পিঠার দোকানের তো অভাব নেই। তার কাছে মানুষ কেন আসবে? চেষ্টা করলেন ভিন্নতা আনার। ব্যস, তাতেই বাজিমাত!
মণ্ডা ও ছিপের জন্য বিখ্যাত ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার মুজাটি ফার্মের মোড়ের দোকানি মো. হাফিজুল এখন দিনে পিঠা বেচে আয় করেন সাত-আট হাজার টাকা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার পিঠাকে কেন্দ্র করে এই মোড়ে জমে আড্ডা। দূর-দূরান্ত থেকে তার পিঠা খেতে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রচুর মানুষ পার্সেল নেন পরিবারের জন্য।
একদিন সন্ধ্যায় হাফিজুলের পিঠার আড্ডায় গিয়ে দেখা যায়, সারি ধরে শুধু ভর্তার বাটি। চুলা জ্বলছে পাঁচটি। হাতের কোনো বিরাম নেই। এরই ফাঁকে কাস্টমারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন, অর্ডার নিচ্ছেন। হাসিমুখে প্রত্যেকের কথা শুনছেন। বোঝা গেলো এটাই তার ব্যবসার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
একসঙ্গে তার দোকানে বসে খেতে পারেন ২০ জনের মতো। দাঁড়িয়ে খাওয়ার লোকও কম নয়। পিঠা বানাতে বানাতেই জানান তার সংগ্রাম-সাফল্যের কথা। দুই পদের পিঠা বিক্রি করেন তিনি। সকালে ভাপা ও বিকেলে চিতই পিঠা। দিনে বিক্রি হয় ১৪-১৫শ’ পিঠা। ভাপা বিক্রি করেন ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত। চিতই বিক্রি শুরু হয় বিকেল ৩টায়। চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। মূলত শীতের আগে-পরে ছয় মাস চলে তার ব্যবসা।
তার এ কাজে সহায়তা লাগে পাঁচজনের। বিক্রিতে সহায়তা করেন দুজন। আর ভর্তা বানানো, ঢেঁকিতে চাল কোটা, উপকরণ তৈরি করে দেন আরও তিনজন। তার স্ত্রী-সন্তানরাই তাকে এ কাজে সহায়তা করেন। পিঠার দাম কিন্তু বেশি নয়, মাত্র পাঁচ টাকা। শুধু ডিম-চিতই বিক্রি করেন ১৫ টাকা। চিতই পিঠার গোলার ওপর ডিম কখনো ফাটিয়ে কখনো গুলে ছেড়ে দেন। কাঠের চুলায় একটি পিঠা রেডি হতে তিন-চার মিনিট লাগে।
তার পিঠার কদর উপজেলাজুড়ে। দোকানে বসে পিঠা খাচ্ছিলেন কয়েকজন যুবক। পিঠার মান কেমন জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘আমরা রেগুলার এখানকার পিঠা খাই। সকাল-সন্ধ্যার নাস্তাটা এখানে হয়ে যায়। মান খুবই ভালো। সব ভর্তাই ভালো লাগে। নিজেরা খাই বাসায়ও নিয়ে যাই। আজ ২০টা অর্ডার করেছি। যারা বেশি ঝাল খায় তাদের জন্য এক ধরনের ভর্তা আর যারা কম ঝাল খায় তাদের জন্য একরকম।’
হাফিজুলের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে ময়মনসিংহে পড়েন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ছোট ছেলে এবার অষ্টম শ্রেণিতে উঠবে। মেয়ে পড়ে মাদরাসায়।
ছোট ছেলে পিঠায় কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী ভর্তা লাগিয়ে দিচ্ছিল। কারও কারও দেখা গেলো বাটিতে আলাদা ভর্তা দিতে। হাফিজুলের পিঠার সঙ্গে আছে সরিষা ভর্তা, ধনিয়া, কালোজিরা, তিল, তিষি, বাদাম, পালংশাক, বাইত্যাশাক, লাউশাক, বেগুন, আলু, টমেটো, চ্যাপা শুঁটকি, চিংড়ি, লোনা ইলিশ, পুঁটি শুঁটকি, টাকি মাছ, কাঁচামরিচ, শুকনো মরিচ, কাঁচকি ও মলা মাছ শুঁটকির ভর্তা।
এত পদের ভর্তা আর মুখের হাসি বিদেশফেরত হাফিজুলের ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছে। তিনি এখন স্বাবলম্বী। চার বছর ধরে তিনি এভাবে পিঠা বানিয়ে চলেছেন। ইচ্ছে আছে ভর্তার সংখ্যা আরও বাড়ানোর। তার পরে অনেকে বহু পদের ভর্তার পিঠা তৈরি শুরু করলেও তার মতো প্রসার কারও ঘটেনি।
আরো পড়ুন:
১১ কিলোমিটারের দৃষ্টিনন্দন উড়াল সড়ক || রূপ বদলে যাবে হাওরাঞ্চলের