নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু বাংলা: দেশে আশির দশকে অ্যাকুয়ারিয়ামের শ্যাওলা ও ময়লা পরিষ্কার করতে বিদেশ থেকে আনা হয় সাকার ফিশ বা সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা গেলেও গত কয়েক বছর ধরে তা ভারত, চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জলাশয়ে দেখা যাচ্ছে।
এ মাছের পিঠ এবং দুই পাশে রয়েছে চারটি বড় পাখনা। দাঁতও বেশ ধারালো। জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড়, ছোট মাছ এদের প্রধান খাবার।
বুড়িগঙ্গায় এক সময় অনেক বেশি পরিমাণ শিং, মাগুরসহ দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন দেশীয় প্রজাতির মাছের পরিবর্তে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে সাকার মাছ। দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায়। সেখানে অন্য সব মাছ বাঁচতে না পারলেও সাকার মাছ দিব্যি রয়েছে। এমনকি পানি ছাড়াও এ মাছ ২৪ ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে।
এ মাছের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে অবহিতকরণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। খাবার হিসেবে এ মাছের মান অত্যন্ত নিম্নস্তরে হলেও এখন রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় বিক্রি চলছে দেদারছে। দামের দিক থেকেও বেশ চড়া। এক কেজি মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। তবে অনেকেই মাছটি কিনলেও বেশিরভাগ মানুষই কৌতূহলী। কেউ কেউ নানা মন্তব্যও করছেন। যদিও পাড়া-মহল্লার বাইরের বাজারগুলোয় এখনও বিক্রি নেই এ মাছের।
শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) সকালে খিলগাঁও (শাহজাহানপুর) রেলওয়ে কলোনিতে দুজন সাকার মাছ বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। বিক্রেতা হাসান জানান, সাকার মাছ এখন নদীতে পাওয়া যায়। আমরা পাইকারি বুড়িগঙ্গা থেকে নিয়ে এসে বিক্রি করি। ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি এ মাছ। মাছ কাটলে এক কেজি থেকে প্রায় ৩০০-৩৫০ গ্রাম বাদ পড়ে। অতিরিক্ত শক্ত হওয়ায় মাছটির চামড়া, মাথা এবং কাটাগুলো ফেলে দেই।
অন্য ব্যবসায়ী সুমন জানান, সাকার মাছ ক্ষতিকর নয়, এটা নদীর মাছ। নদীতে এখন পাওয়া যায়। আমরা নদী থেকে ধরি আবার কারও কাছ থেকে কিনে নিয়ে আসি। মাছটি খেতে বেশ স্বাদ আছে। যারা একবার কিনেছেন তারা বার বার কিনতে চান। তবে অপরিচিত হওয়ায় অনেকেই কেনেন আবার অনেকে কেনেন না। এ মাছটি দেখতে সুন্দর হওয়ায় ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থী বেশি।
রাবেয়া নামে এক ক্রেতা বলেন, মাছটি দেখতে সুন্দর মনে হচ্ছে। এটা হয়তো বাগাড় মাছের ছোট জাত। আগে কেনা হয়নি আজই প্রথম কিনলাম।
শফিকুল নামে অন্য একজন বলেন, এর আগে খেয়েছি ভালোই লাগে। তবে কাটা বেশি, মাছটি কই মাছের চেয়ে শক্তিশালী।
ক্ষতিকর প্রভাব
# দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে তাই উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশবৃদ্ধি ও প্রজননে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
# দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্য ও পরিবেশ নিয়ে প্রতিযোগিতা করে।
# এ মাছটি দ্রুত বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম বলে জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়লে জলাশয়ের পাড়ে ১ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত গর্ত তৈরি করে তা ধ্বংস করে।
# দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু ভক্ষণ করে মাছের বংশ বিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
# জলাশয়ের তলার শ্যাওলা ও জৈব আবর্জনা খায় ফলে জলজ পরিবেশের সহনশীল খাদ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
# সাকার মাছের সঙ্গে স্বল্পায়ু, তৃণভোজী, খরাকাতর দেশীয় মাছের অসম প্রতিযোগিতা হয় বলে দেশীয় মাছের উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ নানা ক্ষতি হয়।
সাকার মাছ নিয়ে করণীয়
গত ৬ ডিসেম্বর মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পরিচালকরা, উপ-পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বৈঠক হয়। যেখানে নেওয়া হয় বেশকিছু সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তগুলো হলো-
১. এ মাছটি যাতে কোনোভাবেই উন্মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে প্রবেশ করতে না পারে।
২. চাষ ও উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া গেলে তা জলাশয়ে ছেড়ে না দিয়ে বিনষ্ট করা।
৩. পুকুর-দিঘি বা চাষের জলাশয় শুকিয়ে বা সেচের মাধ্যমে এ মাছ সম্পূর্ণ নষ্ট করতে চাষিদের উৎসাহিত করা।
৪. আফ্রিকান মাগুর, পিরানহা মাছের মতো মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৮৫’ তে এ সম্পর্কে বিধি সংযোজন করে এ মাছের বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া।
৫. শোভাবর্ধনকারী মাছ হিসেবে বাজারজাতকরণের জন্য হ্যাচারিতে প্রজনন বা লালন-পালন বন্ধ করা।
৬. জেলা-উপজেলাসহ সংশ্লিষ্ট স্থানে লিফলেট বিতরণ, বিটিভিসহ অন্য টেলিভিশন চ্যানেল, বেতার ও পত্র-পত্রিকায় প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মৎস্য চাষি, মৎস্যজীবীসহ সবাইকে উদ্বুদ্ধকরণ ও জনসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া।
৭. পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে এ মাছের ক্ষতির প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে অবহিতকরণ ও মাছের বিস্তার রোধে সচেতনতা বাড়ানো।
৮. বিমান ও স্থলবন্দরের মাধ্যমে এ মাছের কোনো আমদানি যাতে না হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (গ্রেড-১) কাজী শামস আফরোজ বলেন, বেশ কিছুদিন আগেও আমরা মাঠ পর্যায়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম, সেই আলোকে কাজ চলছিল। সম্প্রতি আরও একটি চিঠি দিয়েছি যে, দুই রকম জলাশয়- একটি হলো ক্লোজ ওয়াটার যেটি আমরা কালচার করি। আরেকটি হলো ওপেন ওয়াটার। ক্লোজ ওয়াটারে এ ধরনের মাছ ধরা পড়লে আমরা সেটি ধ্বংস করি। পাশাপাশি সেই পুকুরটা সেচে নতুন করে ট্রিটমেন্ট দিয়ে সাকার মাছের কোনো রকম কিছু না থাকে সবকিছু ধ্বংস করে তারপর মাছ চাষের আওতায় আসবে। ওপেন ওয়াটারের জন্য আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করতে হচ্ছে।
বুড়িগঙ্গায় সাকার মাছ পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সেখানে একটা টিম পাঠিয়েছিলাম। সেখানে লোকাল কমিউনিটি, মৎস্যজীবী ও অফিসাররা আছেন তাদের নিয়ে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করা হয়েছে। কীভাবে এটি পাওয়া গেলো, কীভাবে ধ্বংস করা হবে, সেই পদ্ধতি নিয়ে। আমরা আইনের আওতায় নিয়ে এসে এর আমদানি যাতে একেবারেই বন্ধ করতে পারি তার উদ্যোগ নিচ্ছি।
আরো পড়ুন:
উন্মোচন হলো লবণ ও জলমগ্ন সহিষ্ণু ধানের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স