উজানী ঢল আর টানা বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। প্রতিদিন বাড়ছে নদ-নদীর পানির স্ফীতি। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত করছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী বানের পানিতে ভাসছে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১২টি জেলা। এইসব জেলার নিম্নাঞ্চল পুরোপুরি পানির তলে। জেলাগুলো হলো-কুড়িগ্রাম, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, চাঁদপুর, গাইবান্ধা, জামালপুর, ও বগুড়া। এসব বন্যাকবলিত এলাকার গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে মানুষ। বানভাসিরা গবাদিপশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। পানিতে তলিয়ে গেছে রাস্তা-ঘাট-হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। আমন বীজতলা, আমন ধান খেত ও সবজি খেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। বিপৎসীমার ওপরে পদ্মা-তিস্তা-ধরলা-ব্রহ্মপুত্র-ঘাগট-ধলেশ্বরী-দুধকুমারের প্রবাহ। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বহু স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে।
শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে বহু এলাকায়। বেড়েছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ ও পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব। অনেক এলাকায় বানভাসিরা পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছেন না। প্রধান নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় অভ্যন্তরীণ শাখা নদ-নদী ও চলনবিল উপচে পড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধারে কাজ করছেন উদ্ধারকর্মীরা। করুণ অবস্থা চর ও দ্বীপচরের। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। বানভাসিদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পারাপারের জন্য নৌকা কিংবা কলাগাছের ভেলাই একমাত্র ভরসা। এসব তথ্য আমাদের বন্যা কবলিত ১২ জেলার প্রতিনিধিদের।
কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও গাইবান্ধার অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গতকাল ধরলার পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপত্সীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। তিস্তার পানিও ছুঁই ছুঁই করছে বিপত্সীমা। ফলে জেলার ৯টি উপজেলার আড়াই শতাধিক চর ও নদী সংলগ্ন গ্রাম বন্যার পানিতে ভাসছে। গতকাল পর্যন্ত জেলায় ১৫ হাজার ৫২০ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। গো-খাদ্যের সংকট দেখা দেওয়ায় মানুষজন পানিতে ডুবে বিভিন্ন স্থান থেকে গো-খাদ্য সংগ্রহ করছে। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বন্যার্তদের জন্য নয় উপজেলায় ২৮০ মেট্রিক টন চাল ও ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, বন্যার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কোন বরাদ্দ এখনো পাওয়া যায়নি, তবে হটলাইন ৩৩৩-এ ফোন দিলে খাবার তার বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেই বলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আল ইমরান উল্লেখ করেন।
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার, ধলেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার এবং ঝিনাই নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন উপজেলার নতুন নতুন এলাকা বন্যা কবলিত হচ্ছে। টাঙ্গাইল সদরের চরাঞ্চল, কালিহাতী, ভূঞাপুর, গোপালপুর, নাগরপুর ও বাসাইল এই ৬টি উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা দুর্গতরা বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটের মধ্যে পড়েছেন। জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গনি জানিয়েছেন, বন্যায় ক্ষতি হওয়া সমস্ত এলাকায় খুব শীঘ্রই সহায়তা প্রদান করা হবে।
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নদী তীরের পাঁচ উপজেলার কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন। তাঁত কারখানায় পানি ওঠায় বেকার হয়ে পড়েছেন শ্রমিকরা। অনেক মালিকের তাঁতকল নষ্ট হয়ে গেছে। গতকাল যমুনা নদীর হার্ড পয়েন্টে পানি বিপত্সীমার ৩৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গত ৫৯ বছর পরে সিরাজগঞ্জ শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কাটাখালিতে যমুনা নদীর পানি প্রবেশ করেছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ২ সেপ্টম্বর পর্যন্ত নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। একদিনের ভাঙনে চৌহালী উপজেলার খাসপকুুরিয়া থেকে বাগুটিয়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটারব্যাপী অন্তত ২০টি বসতভিটাসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ জানান, বন্যার বিষয়ে সার্বিক প্রস্ততিসহ নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী এবং ফরিদপুর জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। বাড়তে পারে ব্রহ্মপুত্র নদ, পদ্মা, মনু ও খোয়াই নদীর পানি। এছাড়া যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল থাকলেও আগামী ৪৮ ঘণ্টায় পানির উচ্চতা বাড়তে পারে। তবে গঙ্গা নদীসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি কমছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরও জানায়, যমুনা নদীর আট পয়েন্টের পানি এখন বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদীর মথুরা পয়েন্টের পানি ২ থেকে বেড়ে এখন ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর আরিচা পয়েন্টের পানি ১ থেকে বেড়ে ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টের পানি ২ থেকে বেড়ে ১৪, সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ২২ থেকে বেড়ে ৩২, কাজিপুর পয়েন্টে ১৭ থেকে বেড়ে ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এছাড়া নতুন করে ফুলছড়ি পয়েন্টের ১০, সিরাজগঞ্জ পয়েন্টের পানি ৩৪, পোড়াবাড়ি পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এদিকে পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ৪৩ থেকে বেড়ে ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সুরেশ্বর ও ভাগ্যকুল পয়েন্টের পানি এখন বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। অন্যদিকে আত্রাই নদীর বাঘাবাড়ি পয়েন্টের পানি এখন বিপত্ সীমার ৩৪ থেকে বেড়ে ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ধলেশ্বরী নদীর এলাসিন পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ৩৫ থেকে বেড়ে ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে মেঘনার চাঁদপুর পয়েন্ট , দুধকুমার নদীর পাটেশ্বরী পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। এদিকে ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম পয়েন্টের পানি ৩২ থেকে বেড়ে ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে এখন।
/জেড এইচ