নিখিল মান, ধূমকেতু ডটকম: দেশের পর্যটন খাতের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে হাত দিয়েছে সরকার। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি ১০টি কর্মসংস্থানের মধ্যে ১টি কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটন খাতে। দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটন শিল্পের দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জাতীয় আয়ে পর্যটন খাতের অবদান জিডিপির ৪.৩ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী ১০ বছরে পর্যটন খাতে দ্রুত বর্ধনশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম।
প্রতিবেদন অনুযায়ী অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জিডিপি-তে পর্যটনের অবদান হবে ৬ শতাংশ। সব সূচকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৮তম। পর্যটন উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের অনেক সেক্টরের উন্নয়ন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত। পর্যটন উন্নয়ন হলে পরিবহন সেক্টর, হোটেল মোটেল, রেস্টুরেন্ট, কার পণ্য ইত্যাদি বিকশিত হবে, সৃষ্টি হবে বিশাল কর্মসংস্থানক্ষেত্র।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় জানায়, দেশের পর্যটন খাতের সম্প্রসারণে গৃহিত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমূহের মধ্যে রয়েছে কক্সবাজারের খুরুশকুলে শেখ হাসিনা টাওয়ারসহ ট্যুরিস্ট জোন স্থাপন, কক্সবাজারে হোটেল লাবণ্য নির্মাণ, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের (বাপক) রাজশাহী পর্যটন হোটেল কমপ্লেক্সে আধুনিকমানের হোটেল নির্মাণ, বাপক এর মহাখালীস্থ প্রধান কার্যালয় ভবনের স্থলে বহুতলবিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, বরিশাল জেলায় পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ, দেশের অভ্যন্তরে পর্যটন আকর্ষণীয় এলাকায় ট্যুর পরিচালনার লক্ষ্যে ট্যুরিস্ট কোচ সংগ্রহ, কক্সবাজারস্থ মোটেল প্রবালের জায়গায় পাঁচ তারকা মানের হোটেল নির্মাণ, পার্বত্য জেলাসমূহের বিভিন্ন স্থানে ক্যাবল কারসহ ওয়াটার রাইডস, বিনোদনমূলক পর্যটন সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের বিদ্যমান স্থানসমূহের আধুনিকায়ক ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, পায়রা বন্দর এলাকায় পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই, মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন সুবিধাদি নির্মাণ, হবিগঞ্জে পর্যটন সুবিধাদি সৃষ্টি, রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রিজের পুনঃনির্মাণ, বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ এবং সাতক্ষীরা জেলার মুন্সীগঞ্জে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ ও পর্যটন সম্পর্কে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ প্রদান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক নৈস্বর্গের লীলাভূমি খ্যাত বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। অপরিমেয় সৌন্দর্য-বিস্তৃত এই দেশ যুগ যুগ ধরে বিদেশি পর্যটকদের পাড়ি দিয়ে এনেছে নিজের কাছে। বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। পর্যটনকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করায় বাংলাদেশে এ শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১৪৫ কোটি। ২০২৩ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৮০ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে।
২০২৩ সালের মধ্যে এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ বলে জানিয়েছে ডব্লিউটিটিসি। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজারে টিকে থাকতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপরেখা। আর সেই সাথে আধুনিক সব স্থাপত্য। তবে এসব কিছুই নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির উপর। করোনার প্রভাবে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রতিটি দেশেই বন্ধ ছিল পর্যটন শিল্প। যদিও ২০২১ সালে করোনার টিকা আসার পর আবারো সতেজ হয়ে উঠছে বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশগুলোর পর্যটন খাত।
২০১৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পর্যটন খাতে প্রতি বছর যে হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হিসেবে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টরে যেমন-পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইনসসহ অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতিবছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যেকোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি।
ইতিমধ্যে পর্যটনকে বিশ্বের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনশিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছিল। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এই শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে অথচ এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অনুযায়ী পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন বাংলাদেশ করতে পারেনি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দীর্ঘদিন ধরে পর্যটন সেবার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ট্রিপস এন্ড লিজার (বিটিএল)কর্ণধার শিমুল জাবালি। পর্যটন কেন্দ্রগুলো ঘিরে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পর্যটন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি এ সেক্টরটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ-তরুণীরা এ খাতে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রতিনিয়ত আমরা নানারকম দূরাবস্তার সম্মুখীন হই। প্রধান সমস্যা হলো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পর্যটন খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে নিরাপত্তা খুবই নিম্নমানের। যার কারণে ঘটছে ধর্ষণ, হত্যা, ছিনতাই, মানহানিসহ মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যার কারণে নারীরা ভ্রমণে নিরাপত্তাবোধ করেন না।
তিনি আরও বলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র সুনামগঞ্জের টাঙুয়ার হাওর। এখানে নেই কোনো ট্যুরিস্ট পুলিশ। হাওরে যেসব ট্রলারে করে পর্যটকরা ভ্রমণ করেন সেসব ট্রলারও অসাধু সিন্ডিকেট গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু সুনামগঞ্জ নয়, দেশের বেশিরভাগ পর্যটন এলাকা এ ধরণের অসাধু সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের পর্যটন স্থানসমূহের মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার, সুন্দরবন, রাঙ্গামাটি ঝুলন্ত ব্রিজ, সাজেক ভ্যালি ও লেক, সিলেটের জাফলং, কক্সাবাজরের সেন্টমার্টিন, সিলেটের শ্রীমঙ্গল, রাজধানীর জাতীয় চিড়িয়াখানা, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, রাজধানীর জাতীয় জাদুঘর, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সীতাকুণ্ডের খৈয়াছড়া ঝর্ণা, রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও, কুমিল্লার শালবন বৌদ্ধ বিহার, সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ, নারায়ণগঞ্জের বাংলার তাজমহল, মৌলভীবাজারের মাধবকুন্ড জলপ্রপাত ও মাধবপুর লেক, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মাজার, রাজধানীর বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাদুঘর, চাঁদপুর মোহনা, রাজধানীর পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল, বগুড়ার মহাস্থানগড়, সিলেটের বিছানাকান্দি পাথর কোয়ারী, নারায়ণগঞ্জের পানাম নগর, টাঙ্গাইলের মহেরা জমিদার বাড়ি, সিলেটের সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, খাগড়াছড়ির দর্শণীয় স্থানমূহ, নাটোর রাজবাড়ী, যশোরের মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি, শেরপুর জেলার মধুটিলা ইকোপার্ক, রাজধানীর লালবাগ কেল্লা, নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, কুষ্টিয়ার রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি, গাজীপুরের নুহাশ পল্লী, ছেঁড়া দ্বীপ, বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়, দিনাজপুরের স্বপ্নপুরী পিকনিক স্পট, ভিন্ন জগত রংপুর, তেতুলিয়া জিরো পয়েন্ট ও নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর। এছাড়া দেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে অনেক আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান।
পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। এটি বাস্তবায়ন হলে পর্যটন খাত হবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এ সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করতে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে।
মন্ত্রী বলেন, পর্যটন বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম বৃহত্তম, সম্ভাবনাময় এবং দ্রুত বর্ধনশীল খাত, যা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনবদ্য অবদান রেখেছে এবং একটি দেশের সার্বিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পর্যটন খাতের সম্ভাবনার ছোঁয়া লেগেছে প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যে ঘেরা আমাদের বাংলাদেশেও, যা অনন্য চোখ জুড়ানো আকর্ষণীয় অসংখ্য পর্যটন স্থানসমূহ ঘিরেই বাংলাদেশে রয়েছে পর্যটন বিকাশের অসীম সম্ভাবনা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (এটাব) সভাপতি মনসুর কালাম বলেন, পর্যটন উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের অনেক সেক্টরের উন্নয়ন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত। পর্যটন উন্নয়ন হলে পরিবহন সেক্টর, হোটেল মোটেল, রেস্টুরেন্ট, কার পণ্য ইত্যাদি বিকশিত হবে, সৃষ্টি হবে বিশাল কর্মসংস্থানক্ষেত্র। কিন্তু করোনার মহামারীতে এই সেক্টর কঠিন সংকটে পড়েছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি খুলে দেয়া হলেও দাঁড়াতে সময় লাগবে। অনেক লোকসানে পড়েছে এই শিল্পের উদ্যোক্তারা।
এই সেক্টরকে বাঁচাতে সরকারি সহযোগিতা দরকার।
আরো পড়ুন: