পর্যটন ও পরিবেশ

পর্যটনে অপার সম্ভাবনাময় সুসং দুর্গাপুর

লিমন নন্দি: নেত্রকোনা জেলার একটি উপজেলা দুর্গাপুর। যা সুসং দুর্গাপুর নামেও পরিচিত। ৮০০ বছর বা এরও বেশি আগে এই অঞ্চলে ছিল সুসং রাজ্য, যা কিনা ছিল ভারতবর্ষের অন্যতম প্রভাবশালী রাজ্য। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সুসং রাজ্যের পতন ঘটলেও বর্তমানে দুর্গাপুর নাম নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে রয়ে গিয়েছে।

লেখক হুমায়ূন আহমেদের কল্যাণে তার ভক্তদের কাছে নেত্রকোনা, সুসং দুর্গাপুর, সোমেশ্বরী নদী অতিপরিচিত। কল্পনায় কিংবা বিভিন্ন ছবিতে দেখে সোমশ্বরী নদী বা বিরিশিরি সম্পর্কে আমরা কম বেশি সবাই জানি। কিন্তু বাস্তবে এটা কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় বেষ্টিত সোমেশ্বরী নদী আপনাকে মোহিত করবেই। যারা জাফলং গিয়েছেন অনেকটা তার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন যদিও এখানে পাথর নাই। মেঘালয়ের নীল পাহাড় বেষ্টিত সোমেশ্বরীর সৌন্দর্যে ডুবে যাবেন আর ভাববেন এতো চমৎকার সৌন্দর্য আমাদের দেশের।

কী কী দেখবেন:

বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্প: প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য এ জায়গাটাই বিরিশিরির মূল আকর্ষণ। এখানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় ও সমেস্বরী নদী মিলিত হয়েছে। কারো যদি খুব মন খারাপ থাকে, তিনি যদি মাত্র একটি মিনিট এখানে বসেন, তার মন ভাল হয়ে যেতে বাধ্য। বর্ষাকালে গেলে নদীর পানিসহ পাহাড় খুব ভাল লাগে। তবে পানি তখন ঘোলা থাকে। আর শীতকালে পানি কম থাকে তবে স্বচ্ছ, নিচের বালুও দেখা যায়।

সাধু যোশেফের পল্লী: বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্প থেকে ৫ মিনিটের দূরত্ব। এখানে রাণীখং স্কুল ও গির্জা ঘুরে দেখার মত। এখানে ভাল লাগার জায়গা পাহাড়ের উপর শান্তিকক্ষ নামে বৈঠক খানাটি।

চিনামাটির পাহাড়: চিনামাটির পাহাড় ও নিচের পানিসহ ছবি তুললে খুবই ভাল ভিউ পাওয়া যায়। বর্ষাকালে পানি ঘোলা থাকে আর শীতকালে পানি নীল রঙ ধারণ করে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাদুঘর: গারো, হাজং, খাশিয়াদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও পোশাকের নমুনা দেখতে পারবেন। তাছাড়া এখানে প্রতিদিন উপজাতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। দুর্গাপুর বাজার থেকে জাদুঘর মাত্র ১০ টাকা অটো ভাড়া।

মাধুপুর পল্লী: বিজয়পুর পাহাড় থেকে অটো ভাড়া করে মাধুপুর পল্লী যাবেন। ভারতের সীমানার সাথে দুইপাশে ছোট ছোট টিলার উপর গারো উপজাতিদের বাড়ি আর মাঝখানে রাস্তা। সে এক অপরূপ পরিবেশ।

গারো উপজাতিদের জীবনযাপন: পুরো বিরিশিরি ঘুরে আসলে গারো উপজাতিদের সম্পর্কে ভাল ধারণা পাবেন। এ জন্য আপনাকে আলাদা করে কোথাও যাওয়া লাগবে না।

নদীর একপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পাহাড়। পুরো পাহাড়াই সবুজের চাদরে মাখা। স্বচ্ছ পানির এই নদীতে পাহাড় যেন আয়না দেখছে। নদীর দু’পাড়ে ছোট একটি বালুচর। মাঝখানে কোথাও হাঁটু সমান, আবার কোথাও পানি একদমই নেই। জোয়ার-ভাটার খেলাও দেখা যায় চমৎকারভাবে। বিকালে শুকনো বালির উপরে বা হাঁটুপানিতে হাঁটলেন, রাত পোহালেই পানিতে প্লাবিত আশপাশের অঞ্চল। শীতকালে নদীর পানি ধোঁয়ার মত কুয়াশা বেষ্টিত থাকে। এক কথায়, সোমেশ্বরী নদীর সৌন্দর্য প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।  ঘন কুয়াশা, শান্ত নদী আর পাহাড় মিলে অনন্য।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিরিশিরি। এখানে রয়েছে প্রকৃতির ঢেলে দেয়া অপার সৌন্দর্য। অনেকে জায়গাটিকে সাদা মাটির দেশও বলে থাকেন। নদী, পাহাড় আর সবুজে ঘেরা বিরিশিরিতে রয়েছে অনেক কিছু। কংশ ও সোমেশ্বরী নদী ঘেরা এলাকাটির মূল আকর্ষণ বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড়, নীলাভ-সবুজ হ্রদ, রানীখং গির্জা, কমলা রানীর দীঘি, ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর কালাচারাল একাডেমি ও জিরো পয়েন্ট। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা জনপদ বিরিশিরি, প্রকৃতি প্রেমীদের চোখ জুড়িয়ে দেবে নিমিষেই। গারোদের দেশে পা ফেলতেই যে কারো মন প্রফুল্ল হয়ে উঠবে। কবি হয়ে হয়তো কেউ লিখবেন কবিতা, কেউবা গলা ছেড়ে গাইবেন গান। আর যারা প্রকৃতির এই বিপুল সৌন্দর্যের এক মুঠো সন্দেশ হিসেবে নিতে চান তারা যে সেলফি আর স্ন্যাপচ্যাটে মগ্ন হয়ে যাবেন-এতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রথমেই চলে যান ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর কালাচারাল একাডেমি। সরকারি এ একাডেমিটি মূলত এখানকার উপজাতিদের সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। একাডেমিতে উপজাতিদের বিভিন্ন নিদর্শনের একটি জাদুঘর আছে। খোলা থাকে রবি থেকে বৃহস্পতি সকাল ১০টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত।

একাডেমি থেকে কিছুটা পথ চলার পর দেখা পাবেন বিরিশিরি বধ্যভূমি। সোমেশ্বরীর তীরে এ বধ্যভূমিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। বধ্যভূমি দেখে খেয়াপার হয়ে চলে যান নদীর ওপাড়ে।

নদী পার হয়ে রাস্তায় উঠে আসলেই ঘোরাঘুরির জন্য অনেক অটো পাওয়া যায়। সব জায়গায় ঘোরার জন্য রিজার্ভ অটো নিয়ে নিতে পারেন।

আটোতে করে প্রথমেই চলে যান রানীখং চার্চ এ। এ গির্জাটি তৈরি করা হয়েছে সোমেশ্বরী নদীর কূল ঘেঁষে ঘন গাছপালা বেষ্টিত টিলার উপরে। গির্জার উপর থেকে ভারতের পাহাড়গুলোকে বেশ দেখা যায়। দেখা যায়, বহুদূর বিস্তৃত সোমেশ্বরী নদীও।

গির্জা থেকে বেরিয়ে চলে যান বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্প। ক্যাম্পের ডান দিকে গেলেই দেখা যায় নদী। সেখান থেকে নদীতে ঘোরাঘুরির জন্য ঘণ্টা হিসেবে ছোট আকারের ইঞ্জিন চালিত নৌকা পাওয়া যায়। যা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় সোমেশ্বরী নদীর স্বচ্ছ জলে। নদীর অপরপাশে ভারত সীমান্ত পর্যন্তও যাওয়া যায়।

জিরো পয়েন্ট থেকে চলে যেতে পারেন চিনামাটির পাহাড় দেখতে। যেন মেঠোপথ ধরে চলেছেন বহুদূরে অচেনা এক গ্রামের মাঝে। মানুষজন খুব একটা নেই বললেই চলে। ছোট ছোট ঘরবাড়ির পেছনে দূরে বিশাল বিশাল সব পাহাড়েরা দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো।

চীনা মাটির পাহাড় এবং নীল স্বচ্ছ জলের লেক মূলত একই জায়গায়। আর সাদামাটি বলা হলেও আদতে এর রং হালকা ধূসর থেকে সাদাটে রঙের। কোনো কোনো জায়গায় এছাড়াও আরও কয়েকটি রঙের সমন্বয় রয়েছে। কোথাও গোলাপি, কোথাও রংচটা লাল। তাই আবার জায়গাটিকে লাল কিংবা গোলাপি মাটির পাহাড় নামেও চেনে।

চীনা মাটির এই পাহাড়ের সন্ধান পাওয়ায় সরকার এখানে কোয়েরি করে। তখনই এই পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি হয় হ্রদ৷ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো হ্রদের পানি নীলাভ সবুজ। কেবল সবুজ নয়। বছরের কিছু বিশেষ সময়ে নাকি পানি নীল রঙেরও থাকে৷ বৃষ্টি না হলেই নাকি পানি নীল থাকে। এখন আর খুব বেশি নীলরঙা পানি দেখা না গেলেও একসময় গাঢ় নীলই দেখাত এই হ্রদের পানি। এমনকি আগে লাল রঙা পানিও দেখা যেত।

হরেক রকম রঙের সমন্বয়ের কারণেই ভ্রমণপিয়াসু মানুষের কাছে এই জায়গাটি জনপ্রিয়তা পায়। গোলাপি সাদা রঙা পাহাড়, আর তার নিচে নীলাভ সবুজ জলাধার, উপরে নীল আকাশ এক অপূর্ব মাধুর্যের সমন্বয় সাধন করেছে এখানে প্রকৃতি।

পাহাড় সাগর নদী পলি আর বন মিলিয়ে আমাদের এই ছোট্ট দেশ। আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর। হয়ত আমাদের একটা তাজমহল নেই,আমাদের একটা আইফেল টাওয়ার নেই, নায়াগ্রা ফলস, কিলিমাঞ্জারো নেই কিন্তু আমাদের আছে নেত্রকোনার সুসং, বিরিশিরি, বান্দরবান, সুন্দরবন, কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন এমন হাজরো জায়গা। পুরো পৃথিবী জয় করতে তো সবাই চায়। তার আগে নিজের দেশের সৌন্দর্য কেন চষে দেখবো না। পদক্ষেপ শুরু হোক নিজের ঘরের সৌন্দর্য থেকেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *