বিনোদন

পর্দা থেকে প্রেমের দেবী মধুবালা


ধূমকেতু ডেস্কঃ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে জীবন-গল্পের যবনিকাপাত। কিন্তু এই সামান্য সময়টাই পরিবার, নিজের কাজ, একান্ত ব্যক্তিজীবনের আকর্ষণীয় সব গল্পে অসামান্য করে রেখে গেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে তার জন্ম, ফেব্রুয়ারিতেই শেষ তার জাগতিক ভ্রমণ। তিনি মধুবালা। পারিবারিক নাম মমতাজ জাহান বেগম দেহলভী। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে তিনি ফিরে আসেন আলোচনায়, স্মরণে। মূলধারার গণমাধ্যম ছাড়িয়ে তার চর্চা চলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। বলিউডের মেরিলিন মনরো বলা হতো তাকে। তবে তাকে চেনানোর জন্য মনরোর প্রয়োজন নেই। সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব দাপুটে; অথচ সংবেদনশীল অভিনয় তাকে করেছে অনন্য। তার সময়ে তিনি ছিলেন সবার চেয়ে এগিয়ে। সেই মধুবালার বিষাদময় জীবনের গল্প ছাড়িয়ে যায় ‘ট্র্যাজিক সিনেমা’র কাহিনিও।

মধুবালার নামের সঙ্গে দুটি উপমা প্রায়ই ব্যবহৃত হয়, ‘বিউটি উইথ ট্র্যাজেডি’ ও ‘দ্য ভেনাস কুইন অব ইন্ডিয়ান সিনেমা’। যুগ যুগ ধরে তার সৌন্দর্যের চর্চা চলছে। শুধু বলিউডেই নয়, এর বাইরেও তার সৌন্দর্যের জয়গান চলে ভক্ত-অনুরাগীর মুখে। গুগলের ডুডলে শোভা পায় তার ছবি, ডাকটিকিটে তাকে সম্মান জানিয়েছে ভারত সরকার। যখন ভারতীয় চলচ্চিত্রে পুরোপুরি রঙের ছোঁয়া লাগেনি, সে সময়ও মধুবালায় উজ্জ্বল, রঙিন ছিল বলিউড। তার বায়োপিকে অভিনয়ের জন্য হালের জনপ্রিয় তারকারা তদবির করেন নির্মাতাদের কাছে।

দেবিকা রানী চৌধুরী, সে সময়ে দাপুটে অভিনেত্রী; তিনিই মমতাজ জাহান বেগমের নাম দেন মধুবালা। স্বল্প কর্মময় জীবনে মধুবালা পৌঁছে যান খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু সুখের দেখা কি

পেয়েছিলেন? এমন প্রশ্নে চলচ্চিত্র সমালোচকদের জবাব নেতিবাচক। মধুবালা সুখের দেখা পাননি। ভক্তরা যাঁকে গ্রিক প্রেমের দেবী ভেনাসের সঙ্গে তুলনা করেন, সেই মধুবালা ১৯৩৩ সালের ভালোবাসা দিবসে, অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে জন্মেছিলেন। দারুণ সমাপতন! বাবা আতাউল্লা খান পেশোয়ারের পাঠান। সেখানে তামাক কোম্পানিতে চাকরি হারানোর পর তারা ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমান বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই)। ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল বোম্বে বিস্ফোরণের ঘটনায় হারিয়ে যায় তাদের বস্তির ছোট্ট ঘরটিও। এমন পরিস্থিতিতে শখে নয়, জীবিকার প্রয়োজনে বাবার সংসারে সহায়ক হতে নেমেছিলেন অভিনয় জগতে। ১৯৪৭ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ‘নীল কমল’ সিনেমায় প্রধান অভিনেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন মধুবালা। নীল কমলের চরিত্রে মধুবালাকে নির্বাচন প্রসঙ্গে পরিচালক কিদার শর্মা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘রূপ কিংবা প্রতিভা নয়, আমাকে তার বুদ্ধি ও পরিশ্রম করার ক্ষমতা প্রভাবিত করেছিল। খেয়ে না খেয়ে তিনি যন্ত্রের মতো কাজ করে গেছেন। ভিড়ে ঠাসা ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির বগিতে চেপে প্রতিদিন শুটিংয়ে আসতেন। অথচ কখনো দেরি করেননি।’

১৯৪৯ নির্মিত ‘মহল’ সিনেমাটি ছিল মধুবালার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এরপর তার জনপ্রিয়তা এতই বাড়তে থাকে যে মধুবালার তারকাখ্যাতি ভারত পেরিয়ে সাড়া ফেলে হলিউডেও। ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত থিয়েটার আর্টসে তাকে নিয়ে একটি ফিচার প্রকাশিত হয়, যেখানে মধুবালাকে ‘বিগেস্ট স্টার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ বলে অভিহিত করা হয়। অস্কার বিজয়ী মার্কিন পরিচালক ফ্রাঙ্ক কাপরা তাঁকে দিয়ে হলিউডে অভিনয়ও করাতে চেয়েছিলেন। তাতে অবশ্য মধুবালার বাবা সায় দেননি। যেমনটি দেননি দিলীপ কুমারের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবেও। ১৯৫১ সালে ‘তারানা’ ছবিতে মধুবালা প্রথমবার অভিনয় করেন দিলীপ কুমারের বিপরীতে। মূলত তখন থেকে বন্ধুত্ব। তারা সংসার করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাবার কারণে এ নিয়ে দিনের পর দিন টানাপোড়েনে ছিলেন এই অভিনেত্রী।

একপর্যায়ে দিলীপ কুমার দুটি শর্ত দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এক. পরিবার ছাড়তে হবে; দুই. অভিনয়ও ছাড়তে হবে। অভিনয় ছাড়ার বিষয়ে অবশ্য দিলীপ কুমারের অন্য যুক্তি ছিল,

স্টুডিওর বদ্ধ পরিবেশে মধুবালা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কারণ, তার হৃদ্‌যন্ত্রে জন্মগত ছিদ্র ছিল। অভিনয় ছাড়তে রাজি হলেও পরিবার ছাড়ার শর্ত মেনে নিতে পারেননি মধুবালা। এরপরই বিখ্যাত গায়ক কিশোর কুমারকে বিয়ে করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে ‘চলতি কা নাম’ গাড়ি ছবির সেটেই তাদের পরিচয় হয়েছিল। এর বাইরে আরও কয়েকজনের সঙ্গে মধুবালার প্রেম ছিল। মধুবালার প্রেমে পড়েছিলেন পরিচালক কেদার শর্মা। বয়সে বেশি বড় হওয়ার কারণে তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। পরিচালক কমল আমরোহীর সঙ্গে মধুবালার সম্পর্কের কথা শোনা গিয়েছিল। শোনা যায় প্রেমনাথের কথাও। তবে কোনো প্রেমই টেকেনি।

পর্দা থেকে প্রেমের দেবী

তবে ইতিহাস বলছে, মধুবালা জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন একমাত্র দিলীপ কুমারকে। যেন ‘মুঘল-ই-আজম’–এর সেলিমের প্রেম সর্বহারা ‘আনারকলি’। এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যের ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, মধুবালার বোন মাথুর বুশান বলছেন, ‘আমার বোন পাগলের মতো ভালোবাসতেন দিলীপ কুমারকে। এবং শুধুমাত্র দিলীপ কুমারের প্রতি অভিমানে তাকে শিক্ষা দিতে কিশোর কুমারের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। অভিমান, রাগ আর ক্ষোভে আমার বোন কিশোর কুমারকে বিয়ে করেছিল।’

দিলীপ কুমার-মধুবালার বাস্তব জীবনের প্রেম, ভাঙন আর বেদনাবিধুর বিচ্ছেদ যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল পর্দার সেলিম-আনারকলির চরিত্রে। মধুবালা বারবারই পর্দায় ঝলসে উঠেছিলেন। তবে তার নামের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় ‘মুঘল-ই-আজম’ ছবি। শোনা যায়, মধু-দিলীপের সম্পর্কের গুঞ্জনের বিষয়টি পুঁজি করতে চেয়েছেন পরিচালক কে আসিফ। তিনি দুই তারকার প্রকাশ্য প্রেমকে হয়তো পর্দায় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। ৯ বছর ধরে নির্মিত সিনেমাটি আরও বেশ কিছু ঘটনার সাক্ষী। দিলীপ কুমার-মধুবালার বাস্তব জীবনের প্রেম, ভাঙন আর বেদনাবিধুর বিচ্ছেদ যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল পর্দার সেলিম-আনারকলির চরিত্রে। শোনা যায়, এ সিনেমার নির্মাণকালে এমন অনেক সময় গেছে, যখন তারা পরস্পরের সঙ্গে কথাও বলতেন না। যে যার মতো ক্যামেরার সামনে অভিনয় করে গেছেন।

‘মুঘল-ই-আজম’ মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। তত দিনে মধুবালার শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। হৃদ্‌যন্ত্রের অসুখের বিষয়ে মধুবালাও অবগত ছিলেন। কিন্তু যদি কাজের সুযোগ কমে

যায়, এ ভয়ে তার বাবা এটি প্রকাশ করতে দেননি। বিয়ের পরে লন্ডনে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু তত দিনে আর করার কিছু ছিল না। একসময় অসুখের কাছে কাবু হয়ে

পড়েন মধুবালা। বুকভরা বেদনা নিয়ে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন বলিউডের সর্বকালের সেরা ‘সুন্দরী’। মুম্বাইয়ের জুহুর মুসলিম কবরস্থানে হয় তার শেষ ঠিকানা। যেখানে তার প্রতিবেশী মোহাম্মদ রফি, পারভীন ববি, তালাত মাহমুদরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *