নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হলে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের সেতুবন্ধে তৈরি হবে নতুন মাত্রা। পায়রা বন্দর, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতসহ দুই তীরে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক জোনগুলোকে সরাসরি সংযুক্ত করবে রাজধানীর সঙ্গে। গতি পাবে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলা। দ্রুত যাতায়াতের পাশাপাশি তৈরি হবে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ। প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে ১ দশমিক ২ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হবে।

পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হওয়ায় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসছেন পদ্মার দুই পারের মানুষ। শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে উৎসুক জনতার ভিড় চোখে পড়ার মত। নৌকা ও ট্রলার ভাড়া করে অনেকেই আসছেন সেতু দেখতে। আনন্দ-আবেগে ভাসছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মিছিল-সমাবেশ করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।

পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যখন গাড়ি যাবে দক্ষিণের জনপদে, তখন সেতুর নিচ দিয়ে রেলও চলবে। তাতেই দক্ষিণের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে- এ আশা বুকে নিয়ে বৃহৎ বৃহৎ শিল্প গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অবহেলিত এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন নিয়ে আগ্রহী ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, ইতিমধ্যেই সেতুর দুই পাশে বিশাল এলাকা ঘিরে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে শিল্প। অনেক শিল্পপতি আর পুঁজিপতি শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য বিশাল এলাকাজুড়ে জমি কিনে রেখেছেন। গড়ে উঠছে অনেক স্থাপনা। পদ্মা সেতুর সুফল কাজে লাগিয়ে পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়তে পারে।

বহুদিনের প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে লাগবে গ্যাস। এ দুটো নিশ্চিত হলেই বাড়বে ব্যাপক কর্মসংস্থান। কমবে আয়-বৈষম্য। মোংলা বন্দরে আসবে গতিশীলতা। পায়রা বন্দর সচল হলে বাণিজ্য সম্প্রসারণে পদ্মা সেতু হবে মাইলফলক। গ্রামীণ অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা হবে রপ্তানিমুখী। দারিদ্র্য নিরসন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে।

খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, মৃতপ্রায় মোংলা বন্দর আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন- এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের স্বপ্ন পূরণ হলো। বহু কষ্ট আর বেদনা নিয়ে এই সেতুর স্বপ্ন দেখেছি। এখন আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি দেশের জাতীয় অর্থনীতির চাকাও গতিশীল হবে। দেশি বিনিয়োগের চেয়ে বিদেশি বিনিয়োগ এ অঞ্চলে বেশি আসবে- এমন দাবি করে তিনি বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জমি ও জনবল সহজলভ্য এবং সস্তা হওয়ার কারণেই বিদেশি বিনিয়োগ বেশি আসবে। তাঁর মতে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি প্রস্তুত সেখানে শিল্পায়নের জন্য। তারা অনেকে জমি কিনেছেন। এখন তাদের প্রতীক্ষা- কবে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে, ব্যবসায়ীরা পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার নিশ্চয়তা পেলে শিল্পায়নের ধুম পড়বে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিও বাড়বে। এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, আমাদের দক্ষিণ বাংলায় কোনো শিল্প-কারখানা নেই। ষাটের দশকে কিছু পাটকল হয়েছিল। এর বাইরে দু-একজন শিল্প-কারখানা করার চেষ্টা করেও সফল হননি। এখন পদ্মা সেতু হওয়ার পর যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হবে। এর সঙ্গে খুলনা ও বরিশাল বিভাগে গ্যাসের লাইন পাওয়া গেলে যথেষ্ট বিনিয়োগ আসবে। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর দুই তীর ঘিরে কয়েকটি অর্থনৈতিক জোনের পরিকল্পনা করেছেন। এগুলো করতে পারলে আগামী ১০ বছরে পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হওয়া অর্থ উঠে আসবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু উন্নয়নের মাইলফলক। যা এদেশের মানুষের কাছে নতুন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। পদ্মা সেতুর প্রেরণা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের সব উন্নয়ন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব হবে।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ-উজ্জামান বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গ্যাসের অভাবে খুলনা অঞ্চলে বড় কোনো শিল্প-কারখানা তৈরি হয়নি। মোংলা বন্দরের সঙ্গে ঢাকাসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বন্দরও গতি পায়নি। পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত পণ্য পাঠানো সহজ হওয়ায় মোংলা বন্দর গতিশীল হবে। এতে অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা মোংলা বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে উৎসাহিত হবেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, যশোর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে। সেতুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি উৎপাদন বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসনসহ জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়াও পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়েতে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থার পাশাপাশি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ও সুযোগ সৃষ্টি হবে।

জানা গেছে, প্রায় ছয় হাজার একর এলাকাবিশিষ্ট পায়রা বন্দরকে ঘিরে নানা স্বপ্ন বুনছে সরকার। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে এখানেই গড়ে উঠবে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-প্রতিষ্ঠান। নির্মিত হবে সার কারখানা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল-এসইজেড, জাহাজ নির্মাণ, এনএলজি টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল। উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় থাকবে উপকূলজুড়ে সবুজ বেষ্টনী এবং ইকো-ট্যুরিজম।

জানা গেছে, সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা পায়রা বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রে উন্নীত করা সম্ভব। বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহী করতে পায়রায় নির্মিত হবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কমপ্লেক্স, জাতির পিতার ভাস্কর্য, পর্যবেক্ষক টাওয়ার, ইকোপার্ক ও ফরেস্ট, মেরিন ড্রাইভ, মেরিন পার্ক, সি অ্যাকুরিয়াম, স্টেডিয়াম, গলফ কোর্স, টেনিস, মসজিদ ও কনভেনশন সেন্টার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *