উদ্যোগ ও উদ্যোক্তাজাতীয়সর্বশেষ

পদ্মা সেতুর নেপথ্য কথা অনুষ্ঠান

পদ্মা সেতুর নেপথ্য কথা অনুষ্ঠান

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক আয়োজন ‘রাজনীতির সাতকাহন’-এর পঞ্চম পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর পদ্মা সেতুর নেপথ্য কথা অনুষ্ঠান এ অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম আমিন। শুক্রবার (২৭ মে) রাত ৯টায় আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার হয়।

আলোচনার শুরুতে পদ্মা সেতুর ইকোনমিক্যাল ইম্প্যাক্টটা কী হবে, সে বিষয়ে সঞ্চালক আমিনুল ইসলাম জানতে চান প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের কাছে। মসিউর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন পদ্মা সেতু করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন আমরা প্রথমে বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে অনুরোধ করি অর্থায়নের জন্য। এ দুই প্রতিষ্ঠান প্রথমে অস্বীকৃতি জানায়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক মৌখিকভাবে এবং বিশ্বব্যাংক চিঠি দিয়ে অস্বীকৃতি জানায়। তখন আমরা পুরনো দৃষ্টান্ত অনুসরণ করি। বঙ্গবন্ধু যখন জাপানে গিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে, তখন উনি যেসব প্রকল্পে জাপানের বিনিয়োগের কথা বলেন, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু ছিল। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে কিছু কাজ শুরু হয়েছিল কিন্তু তার হত্যার পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ বড় দুটি নদী দিয়ে বিভক্ত। সেতু দিয়ে এ দেশটাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। এর একটি উদ্যোগ নিয়েছিল বঙ্গবন্ধু এবং অপরটি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। এ বড় দুটি কাজই আওয়ামী লীগের। বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক যখন না করল, তখন প্রধানমন্ত্রী জাপান যান এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে দু-একটি প্রকল্পের বিষয়ে অনুরোধ করেন। তার মধ্যে পদ্মা সেতু ছিল। বছরের শেষ দিকে জাইকা এবং জাপানের কর্মকর্তারা এসে জানালেন দু-একদিনের মধ্যে আমাদের জানাতে হবে, আমরা কোন প্রকল্পটি চাই। প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে যাচ্ছিলেন, তিনি বললেন আপনি আমার সঙ্গে চলেন। যেতে যেতে এ বিষয়ে কথা হবে। সবকিছু শোনার পর প্রধানমন্ত্রী খুব সহজেই বললেন, পদ্মা সেতু করলে তো বোধহয় ভালো হয়। পদ্মা সেতু করলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ কেমন হবে?

প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, বরিশাল-পটুয়াখালী-খুলনার কথা যদি বলেন এসব অঞ্চলে আমি বাস করেছি এবং খুলনাতে আমার বাড়ি। খুলনাতে যেতে ছয় ঘণ্টা লাগবে। তেমনি বরিশাল বা পটুয়াখালী যেতে ছয় বা সাড়ে ছয় ঘণ্টা লাগতে পারে। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাহলে তো রাজধানীতে সব মানুষ দ্রুত যেতে পারবে। তিনি বলেন, এই যে অনুভূতি আমি এ জন্য বলি- আমাদের চারদিকে যা আছে, তার বাইরে দৃষ্টি যায় না। দেশের নেতৃত্ব যারা দেবেন, তাদের দৃষ্টি আরও প্রসারিত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনন্য।

আমরা যখন জাপানকে জানালাম যে, আমরা পদ্মা সেতু চাই তখন বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ফিরে এলো। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রথমে এটাকে ফিজিবিলিটি করে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থসহায়তা দেয় বিশ্বব্যাংক, জাইকা এবং তার পরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। ইসলামি ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কিছুটা অংশ ছিল।

মসিউর রহমান বলেন, আমার ওপর যে চাপ ছিল, কেবল ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ছাড়া অন্য যারা এখানে অর্থায়ন করেছে, বিশ্বব্যাংক এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং জাইকা এরা একদিন সকালে আগে সময় ঠিক করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইল। প্রথমে তারা বলল, জাপানি অ্যাম্বাসি অফিসে। আমি বললাম, সেখানে আমি যাব না। আমার যুক্তি ছিল যে, মানুষের ধারণা হবে বা প্রচার হবে আমি তাদের কাছে নত হয়ে কোনো সুবিধা চাচ্ছি। আমি বললাম, তোমরা আমাদের এখানে আস। জাপানি অ্যাম্বাসেডর বলল তোমার ওখানে গেলে জার্নালিস্টদের ফেস করতে হবে। আমি বললাম, জার্নালিস্টদের আমি ফেস করব। ওরা এসে আমাকে যেটা বলল যে, আমাকে দায়িত্ব ত্যাগ করতে হবে, দেশও ত্যাগ করতে হবে। দেশত্যাগের শর্ত হলো তারা আমাকে বিদেশে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে বা কোথাও একটা কনসালটেন্সি জোগাড় করে দেবে এবং আমি যে বেতন চাই তাইই ব্যবস্থা করে দেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কিছু কাজ ঠিক করে দেবে এবং আমাকে তারা টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেবে। আমার উত্তর হলো যে, দেখ আমার যদি টাকা করার ইচ্ছা থাকত তাহলে এখানেই তো টাকা করতে পারতাম।

এ সময় পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির সঙ্গে মসিউর রহমানের সম্পৃক্ততা নিয়ে যে ষড়যন্ত্র ছিল তা নিয়ে সঞ্চালক বলেন, স্যার, একটা জিনিস জানতে চাই, আপনি যখন বলেছেন আমার সুন্দর একটা জিনিস মনে পড়েছে। ওরা আপনাকে শর্ত দিল যে আপনাকে দেশ ছাড়তে হবে, সেক্ষেত্রে আপনাকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে অথবা অন্য কোনো ভালো জায়গায় কনসালটেন্সি দেবে। এতে কি প্রমাণিত হয় না যে, আপনি আসলে কোনো দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। কারণ আপনি যদি দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন তাহলে তারা আপনাকে অ্যাওয়ার্ড দিতে চাইবে কেন। এতেই তো প্রমাণিত হয় যে এর পেছনে বিশাল ষড়যন্ত্র ছিল।

মসিউর রহমান বলেন, তারা যে প্রস্তাব দিয়েছিল এটা সামঞ্জস্যহীন প্রস্তাব। যে দোষ করেছে তাকে আবার পুরস্কৃত করবে। এর পেছনে যে বুদ্ধি তাদের ছিল, সেটা হলো আমি যে এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলাম। যেটা আমার বলা উচিত হবে এবং না বলাটা অনুচিত হবে। সেটা হলো আমার এ শক্ত পজিশন নেওয়ার ক্ষমতাটা কোথা থেকে এলো। তার আগে একটু বলি, মাঝখানে যে বিশ্বব্যাংক বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও কিছু গুরুজন স্থানীয়, যারা প্রভাবশালী, দু-একজন আমার বন্ধু, তারাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত, বন্ধু হিসেবে তারা আমাকে বলেছে যে, তোমার নামে এসব ছড়াচ্ছে তুমি কেন দায়িত্ব ত্যাগ করো না এবং দেশ ছাড় না কেন। আমি বললাম যে, দেখ আমি দেশের বাইরে গেলে আমার পায়ের তলায় মাটি থাকবে না। আমার ক্ষমতা ততদিন যত সময় আমি দেশের মধ্যে আছি। আরেকটি হলো প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাহস জুগিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি যেটা বলি সেটা হলো, আমার ওপর একটা বড় ছায়া আছে। সেটা হলো বঙ্গবন্ধুর ছায়া। ওই ছায়া যত দিন থাকবে তত দিন আমি নিরাপদ। ওই ছায়া যেদিন থাকবে না, ওই ছায়া থেকে যেদিন আমি সরে যাব, সেদিন আমি সহায়হীন। এই বলেই কান্না করতে থাকেন মসিউর রহমান। তাকে এ সময় শান্ত্বনা দেন সঞ্চালক। এ ছাড়া আলোচনায় অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকও এ সময় মসিউর রহমানকে শান্ত্বনা দেন। এর কিছুক্ষণ পরই অনুষ্ঠান শেষ হয়।

বাঙালির গৌরবের প্রতীক পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। অপেক্ষা উদ্বোধনের। কিন্তু একটু পেছন ফিরলে দেখা যায় এ সেতু ঘিরে ছিল নানা ষড়যন্ত্র। ছিল দুর্নীতির কল্পিত অভিযোগ।

এ ছাড়া ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, পদ্মা সেতু এ আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। জোড়াতালি দিয়ে বানানো সেতুতে, কেউ উঠবেও না।

এরপর একের পর এক পদ্মা সেতুবিরোধী মন্তব্য আসতে থাকে বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকে।

রাজনৈতিক বিরোধিতার সুরে তাল মিলিয়ে ‘কান নিয়ে গেছে চিলে’ এমন রব তোলেন কয়েকজন সুশীলও। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার পদ্মা সেতু নিয়ে বলেছিলেন, দুর্নীতি আমাদের কীভাবে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে তার আরেকটি উদাহরণ এটি (পদ্মা সেতু)। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

সরকার সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করায় দুঃখ পান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেছিলেন, প্রথম অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব হলো অভিযোগ অস্বীকার করে যাওয়া। অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে, কিছু কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দাতাগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে পারেনি।

অপরদিকে দুদকের বিচার করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছিলেন, দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল কোনো প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু কানাডার পুলিশ এসে এ দুর্নীতির প্রমাণ দিয়ে গেছে। এ ঘটনা নিয়ে তদন্ত করার সামর্থ্য আছে কি না দুদকের, সেটি নিয় আমার সন্দেহ রয়েছে। এ ঘটনার তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা তাদের আছে কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

পদ্মা সেতুবিরোধী নানা মহলের সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে।

সে সময়ে সংবাদমাধ্যমে ড. মসিউর রহমান বলেছিলেন, আপনাদের কাছে আমি সহানুভূতি চাই। আপনারা আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করুন।

শেষমেশ বাধ্যতামূলক ছুটিতে যেতে হয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টাকে, দেড় মাস জেল খাটেন সেতু সচিব, ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি পদত্যাগই করতে হয় তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে। দফায় দফায় তাদের হাজিরা দিতে হয় দুদকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *