স্বাস্থ্য

গরিবের ভরসা নিউরো হাসপাতাল

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: নামমাত্র ফি দিয়ে নিউরো রোগের নানা জটিলতার চিকিৎসা মিলছে রাজধানীর সরকারি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালে। লাখ টাকার চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে হাজার টাকায়। প্রতিষ্ঠানটির উপর বেড়েছে মানুষের আস্থা। এটি নিউরো রোগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার দেশের একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল। ২৪ ঘন্টা খোলা থাকা এই হাসপাতালে সারাদেশের রোগীদের ভিড় লেগেই থাকে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে গড়ে উঠা সাড়ে ৪শ’ বেডের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালের ইমার্জেন্সি, বহির্বিভাগ, আন্তঃবিভাগ-সর্বত্র রোগী ও তাদের অভিভাবকদের ভিড়। হাসপাতালটির বহির্বিভাগ ও  আন্তঃবিভাগ বেশ পরিচ্ছন্ন ও খোলামেলা। দশ বছরের ছেলেকে বহির্বিভাগে দেখাতে এসেছেন মিরপুরবাসী আয়েশা বেগম। তিনি ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, গত দুই বছর ধরে আমার ছেলে মাথা ব্যথায় ভুগছে। গ্রীনরোডে একটি চেম্বারে চিকিৎসক দেখিয়েছি। নিউরো হাসপাতালে দেখানোর পরামর্শ দিলেন তিনি। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে এই হাসপাতালের চিকিৎসককে দেখিয়েছি। তার পরামর্শে ওষুধ খেয়ে বেশ উন্নতি হয়েছে। এখানে বিভিন্ন টেস্ট করোনার  ফি বাইরের তুলনায় অনেক কম বলে জানান আয়েশা বেগম।

স্ট্রোকে আক্রান্ত জয়নাল মিয়াকে (৬৫) নিয়ে এসেছেন তার ছেলে ওসমান মিয়া। রোগীর একটি হাত সার্বক্ষণিক নড়ে। ওসমান মিয়া জানান, মাঝারি ধরনের স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়ার পর বাবার পারকিনসন দেখা দিয়েছে। সব সময় বাম হাত নড়তে থাকে। এই প্রকার নিউরো রোগের চূড়ান্ত চিকিৎসা না থাকলেও জটিলতর অবস্থায় যাওয়ার পথ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। বেসরকারি হাসপাতালে অনেক ব্যয়বহল। এই হাসপাতালে এসে স্বল্প টাকায় সন্তোষজনক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন বলে জানান ওসমান মিয়া।

এভাবে আয়েশা  বেগম ও জয়নাল মিয়ার মত অসংখ্য রোগী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হাসপাতালে আসে বলে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে।

হাসপাতালের কর্মচারীরা জানান, একটি দিনও একটি বিছানা খালি থাকে না। শুধু তাই না, অনেক সময় শয্যা খালি না থাকায় ভর্তিযোগ্য রোগীকে ভর্তি করানো সম্ভব হয়ে উঠে না। কম টাকায় উন্নত ও ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে হাসপাতালটির চিকিৎসকেরা জানান, বাংলাদেশে নিউরো রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আর পৃথিবীতে স্ট্রোক হচ্ছে মৃত্যুর অন্যতম কারণ। যতটা ঝুঁকিতে আগে মানুষ হৃদরোগে থাকতো, কার্ডিওলজিতে ভর্তি হতো, স্ট্রোক নিয়ে এখন মানুষ ততটাই ঝুঁকিতে থাকে।

এখানে স্ট্রোকের পাশাপাশি আসে ব্রেইন টিউমারের রোগী, আসে ডিমেনসিয়া ও পারকিনসন রোগী। যে কোনো ধরনের প্যারালাইসিসের রোগীও আসে। এছাড়া আসে জিবিএস, যে রোগে মানুষের নার্ভগুলো অকেজো হয়ে যায়, মেনিনজাইটিস ও এনকেফালাইটিসের রোগীরাও।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে প্রতিদিন বহির্বিভাগে নিউরোলজি বা নিউরো সার্জারি মিলিয়ে রোগী আসেন কমপক্ষে দেড় হাজার। আর জরুরি বিভাগে প্রতিদিনি কমপক্ষে একশ থেকে ১২৫ জন। সব মিলিয়ে আমাদেরকে প্রতিদিন ১৬-১৭শ’ রোগী দেখতে হয়। এর বেশিরভাগই আমরা বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে থাকি অথবা জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। আর কিছু রোগী, যাদের বাইরে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়, কেবল তাদেরকে আমরা ভর্তি করে থাকি।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, এখানে চিকিৎসা ব্যয় তেমন নেই। কেবল সরকারের নির্ধারিত একটা সামান্য ফি আছে। যেমন: একটা সিটি স্ক্যান বাইরে করাতে লাগে সাড়ে ৪ হাজার টাকা আর এখানে লাগে ২ হাজার টাকা। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, গরিব রোগী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিকিৎসা একদম ফ্রি। এছাড়া দুঃস্থ ও পথচারী যারা দুর্ঘটনায় পড়ে হাসপাতালে আসেন, যাদের কোনো আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ পাওয়া যায় না তাদের জন্যও ফ্রি।

ভর্তি হওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে পেয়িং বেডের জন্য সপ্তাহে ২৬০ টাকা লাগে। এসি কেবিনের ভাড়া হচ্ছে মাত্র ৫০০ টাকা, আর ডাবল শেয়ার কেবিন ২৫০ টাকা। অপারেশনের খরচও এখানে খুবই নগণ্য। বড় অপারেশন মাত্র ২ হাজার আর ছোট অপারেশনে ১ হাজার টাকা লাগে। যে অপারেশন বেইরে করালে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা লাগতো, সেই অপারেশনটি এখানে করালে মাত্র ২ হাজার টাকা লাগে। এমনকি গরিব রোগীদের ফ্রিও করানো হয়। এখানে নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয় বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

নিউরো সমস্যাসমূহের লক্ষণ সম্পর্কে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল নিউরো সার্জারী বিভাগের ব্রেইন ও স্পাইনাল সার্জন ডা. মু. ইসমাইল হোসেন বলেন, শারীরিক কাজে অক্ষমতা, মাংসপেশীর দুর্বলতা, ইন্দ্রিয়শক্তির দুর্বলতা, কথা-বার্তা, কাজে-কর্মে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা, চোখে হঠাৎ ঝাপসা দেখা, ঘন ঘন মাথা ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিবে।

নিউরো রোগের কারণ ও লক্ষণ সম্পর্কে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, এ ব্যাপারে সচেতনতা খুবই দরকার। একটা বড় লক্ষণ হচ্ছে, হঠাৎ করে একটা সাইড অবশ হয়ে যাওয়া। এছাড়া হঠাৎ করে তীব্র মাথাব্যথা, হঠাৎ করে বমি, খিঁচুনি, চোখে না দেখা, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া- এইগুলোই হচ্ছে মূলত নিউরো রোগের লক্ষণ। এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে, বুঝতে হবে তার ব্রেইনের সমস্যা, তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ১ বছরে হাঁটার কথা, আট মাসে বাবা-মাকে ডাকার কথা। যখন দেখা যাবে একবছরেও হাঁটছে না, বাবা-মাকে ডাকছে না, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশছে না, খেলাধূলায় অংশগ্রহণ করছে না, তখন বুঝতে হবে ব্রেইনে কোনো সমস্যা আছে।

আর বয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকে তার বাসা চিনতে পারছে না, নিজের স্বাক্ষর ভুল করছে তখন ধরে নিতে হবে তার ব্রেইনের রোগ হয়েছে।  অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম আরও জানান,  যেসব কারণ আমাদের জানা, সেগুলো সবারই জানা দরকার। যেমন: যাদের ব্লাড প্রেসার বেশিদিন অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তাদের অল্প বয়সে স্ট্রোক হতে পারে, আর যাদের ডায়াবেটিক আছে, যদি নিয়ন্ত্রণ না করে তাহলে তারও স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার যেসব মায়েরা জর্দা খান, সাদা পাতা, পান পাতা খান, সেটা ভয়ানক ক্ষতিকর এমনকি ধূমপানের চেয়েও ক্ষতিকর। এছাড়া ইয়াবা, হিরোইন, মদপান বা যে কোনো ধরণের নেশা করলে স্ট্রোক করার ঝুঁকি থাকে।

আরো পড়ুন: 

প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা : প্রয়োজন সচেতনতার

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *