নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: পুরান ঢাকার অনেক মানুষের একটু শ্বাস নেওয়ার জায়গা বাহাদুর শাহ পার্ক। আদালত পাড়া, হাসপাতাল, বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গায়ে গায়ে লেগে থাকা দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর যানবাহনের হট্টগোলের মধ্যে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিল ইতিহাসমাখা পার্কটি।
পার্কের প্রাণ ফেরাতে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণে অবশেষে হাত লাগায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (এমপি)’ আওতায় গতবছরের মার্চ থেকে ঐতিহাসিক পার্কটির সংস্কারকাজ শুরু হয়। এক বছর ধরে সংস্কার শেষে এ বছরের ১১ মার্চ পার্কটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: দুয়ারে হাজির হেমন্ত
নতুন সাজে সজ্জিত পার্কে পথচারীদের জন্য ডিম্বাকারে ৭৪০ মিটার হাঁটার পথ, শৌচাগার, বেঞ্চ, সবুজ উদ্যান, এমফি থিয়েটার গ্যালারি তৈরি করা হয়েছে। নতুন করে সাজানো হয়েছে সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিস্তম্ভ। বৃষ্টির পানি অপসারণের জন্য পার্কের চারপাশে চারফুট গভীর নালা করা হয়েছে। নাগরিকদের জন্য ২৪ ঘণ্টা পার্কটি ব্যবহার উপযোগী করে সংস্কার করা হয়েছে। এজন্য রাতে আলোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
৮৫ দশমিক ০৩ কাঠা আয়তনের এই পার্ক সংস্কারে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সিভিল সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুন্সী মো. আবুল হাসেম।
তিনি বলেন, “বাহাদুর শাহ পার্কের সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো জটিলতা ছিল না। পরিকল্পনামাফিক সবটাই বাস্তবায়ন করা হয়েছে।”
তবে ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহর বড় ছেলে খাজা হাফিজুল্লাহর স্মৃতিবিজড়িত গ্রানাইট পাথরের তৈরি স্তম্ভটি সংস্কার ছাড়াই রয়ে গেছে এখনও।
এ প্রসঙ্গে আবুল হাসেমের ভাষ্য, স্তম্ভটির মূল বেদিতে যে ভাঙ্গা অংশ রয়েছে, সেটি সংস্কার করা হলেও আগের রূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। তাই কনসালটেন্টদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সেখানে সংস্কার করা হয়নি।
তবে স্মৃতিফলকের অস্পষ্ট লেখাগুলোকে স্পষ্ট করার জন্য শিগগিরই নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
পার্কের সীমানায় পথচারীদের হাঁটার পথে এখনও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির দুটি খুঁটিও রয়ে গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাসেম বলেন, “সিটি কর্পোরেশনের আওতায় না থাকায় এটি সরানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে গত চার পাঁচ মাস ধরেই ডিপিডিসিকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে এটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য। তারা আশ্বাস দিয়েছে, দ্রুতই পোলগুলো সরিয়ে নেবে।”
তবে পার্কের সংস্কারের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন ‘অনেকটাই তাড়াহুড়ো’ ও ‘অস্পষ্ট’ হয়েছে বলে মনে করেন আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম।
তিনি বলেন, “এখানে অনেকগুলো কাজই করা হয়েছে। তবে চূড়ান্তভাবে কী অর্জন হল, সেটি অস্পষ্ট। সাবেক মেয়র চলে যাওয়ার আগে অনেকটাই তাড়াহুড়ো করে কিছু একটা শেষ করতে হবে বলে এটা করে দিয়ে গেল বলে মনে হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবেই কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। কোনো স্তম্ভের পরিবর্তন চাইলেই হুট করে করা সম্ভব না।”
শুধু বাহাদুর শাহ পার্ক নয়, আশপাশের এলাকা, ঐতিহ্যবাহী ভবন এবং ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা করা উচিত ছিল বলে মনে করেন তাইমুর।
“সেন্ট থমাস চার্চের ভেতরকার স্তম্ভটি দেখা যায় না, কবি নজরুল কলেজের মূল ভবন দেখা যায় না। কারণ এর সামনে একটি চারতলা বিল্ডিং তৈরি করে রেখে দেওয়া হয়েছে।”
‘আন্টাঘর’ থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই উদ্যানটি।
আঠার শতকের শেষ দিকে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল এখানে। বিলিয়ার্ড বলকে স্থানীয়রা বলত ‘আন্টা’, সেই থেকে আন্টাঘর।
১৮৫৮ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণের ঘোষণা এই ময়দানেই পাঠ করে শুনিয়েছিলেন ঢাকা বিভাগের কমিশনার। এরপর থেকে স্থানটি হয়ে যায় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’।
১৯৫৭ সালের আগে পর্যন্ত পার্কটি এই নামেই পরিচিত ছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ শাসকেরা ফাঁসি দেয় অসংখ্য বিপ্লবী সিপাহীকে। তারপর জনগণকে ভয় দেখাতে তাদের মরদেহ এনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় পার্কের গাছগুলোতে।
১৯৫৭ সালে (মতান্তরে ১৯৬১) সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম বদলে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য। তাই তার নামেই নতুন নামকরণ করা হয়।
এই পার্ক নিয়ে স্থানীয় অনেক প্রবীণ এখনও স্মৃতিকাতর হন। তাদের কাছে এখনও এটি ভিক্টোরিয়া পার্ক। এমনই একজন পোস্তগোলা এলাকার হাফেজ মো. সাইফুল্লাহ।
আশির কোঠায় পা দেওয়া এই প্রবীণ বলেন, “আমরা এখনও ভিক্টোরিয়া পার্ক হিসেবেই চিনি। এককালে কবি নজরুল কলেজের বন্ধুদের সাথে এখানে আড্ডা দিতাম বিকালে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম ভিক্টোরিয়া পার্কে। এখন আর যাওয়া হয় না। আগে ওই এলাকার চেহারাই অন্যরকম ছিল। সময়ের সাথে সাথে ঢাকার মানুষ বেড়েছে, গাড়িঘোড়া বেড়েছে। সবকিছুই বদলেছে।
“মার্চে সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে বলে শুনেছি। তবে অনেকদিন যাওয়া হয় নাই ওইদিকে।”
বাহদুর শাহ পার্ক ঘিরে সাতটি রাস্তা একত্রিত হয়েছে। এর চারপাশে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ বেশকিছু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় এটি পুরান ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। পার্কের উত্তর পাশে রয়েছে সেন্ট থমাস চার্চ, এর পাশে পানি সরবরাহ করার জন্য তৈরি ঢাকার প্রথম ট্যাংকি। উত্তর-পূর্ব কোণে আছে ঢাকার অন্যতম পুরনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং ইসলামিয়া হাই স্কুল, পূর্ব পাশে রয়েছে ঢাকার আরেক পুরনো প্রতিষ্ঠান সরকারি মুসলিম স্কুল, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
পার্কের ঠিক উত্তর-পশ্চিম পাশেই রয়েছে ঢাকা জজ কোর্ট। এছাড়া বাংলাবাজার, ইসলামপুর, শাঁখারী বাজারের মত ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকাগুলো পার্কের কাছাকাছি অবস্থিত।