তথ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

উন্নত ইন্টারনেট সেবা দিতে ব্যান্ডউইথের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: দেশে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবার নিম্নমান নিয়ে গ্রাহকের অভিযোগের অন্ত নেই। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। সে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ফোরজি সেবা চালু করলেও এখন পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন ব্যবহারে কার্যত যেতেই পারেনি দেশের শীর্ষ তিনটি মোবাইল ফোন অপারেটর। গ্রাহক অনুপাতে পর্যাপ্ত বেতার তরঙ্গের ব্যবহার তারা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তিনটি অপারেটর নতুন বরাদ্দ নেওয়া বেতার তরঙ্গের ব্যবহার গত ছয় মাসে ৫০ শতাংশও নিশ্চিত করতে পারেনি। একই সঙ্গে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ ব্যান্ডউইথও ব্যবহার করা হচ্ছে না। যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে, ভয়েস কলে ঘন ঘন ড্রপ এবং মোবাইল ইন্টারনেটের ধীরগতি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রাহক অনুপাতে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার ও অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফেন অপারেটর টেলিটক।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানিয়েছেন, এ প্রতিবেদনের আলোকে মোবাইল অপারেটরদের সেবার গুণগত মান বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এরই মধ্যে বিটিআরসিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী বিটিআরসি কাজও শুরু করেছে। এতে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবার মানে বড় পরিবর্তন আসবে বলে আশা করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোরজির যুগে এসেও মাইক্রোওয়েভের ওপর নির্ভরশীল হয়ে সেবা দেওয়ার কারণেই অসহনীয় কলড্রপের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে গ্রাহকদের। এ অবস্থায় অদূর ভবিষ্যতে ফাইভজিতে গেলেও কার্যক্ষেত্রে ওই মানের সেবা পাওয়া যাবে না বললেই চলে।

যা আছে বিটিআরসির প্রতিবেদনে : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফোরজি সেবায় বর্তমানে মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে বিটিএস পর্যায়ে (বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন) গ্রামীণফোনের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশনের ব্যবহার মাত্র ১২ শতাংশ, রবি আজিয়াটা লিমিটেডের ১৮ শতাংশ এবং বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনের ১৩ শতাংশ।

অর্থাৎ গ্রামীণফোনের যত বিটিএস আছে তার মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশের সঙ্গে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ আছে। ৮৮ শতাংশ চলছে মাইক্রোওয়েভ দিয়ে। বর্তমানে গ্রামীণফোনের মোট বিটিএস আছে ১৭ হাজার ৮২১টি শতভাগ ফোরজি সাইট।

বিটিআরসির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণফোনে বর্তমানে মাত্র ২ হাজার ১৩৮টি সাইটে অপটিক্যাল ফাইবার কানেকশন আছে। একইভাবে রবির বর্তমানে মোট বিটিএস সংখ্যা ১৩ হাজার ৭৬৬টি। ১৮ শতাংশ হিসেবে রবির মাত্র ২ হাজার ৪৭৮টি সাইটে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ আছে।

বাংলালিংকের বিটিএস সংখ্যা ১০ হাজার ১৪৯টি। ১৩ শতাংশ হিসেবে অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ৩১৯টিতে। টেলিটকের বিটিএস সংখ্যা ৫ হাজার ৪০০টি। ৬৭ শতাংশ হিসেবে ৩ হাজার ৬১৮টিতে অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন আছে।

সংশ্নিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বর্তমানে তিনটি মোবাইল অপারেটর ট্রান্সমিশন সেবাদাতা এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ এমবিপিএস থেকে ৫০০ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ পর্যন্ত ট্রান্সমিশন সেবা নিচ্ছে ব্যাকহল হিসেবে। যেখানে পার্শ্ববর্তী ভারত, শ্রীলংকায় অপারেটরদের ব্যবহূত ট্রান্সমিশন ব্যাকহলের পরিমাণ ১ জিবিপিএস (এক হাজার এমবিপিএস) থেকে ১০ জিবিপিএস। বর্তমানে বাংলাদেশের এনটিটিএন অপারেটরদের ব্যাকবোন ১০০ জিবিপিএস এবং ব্যাকহলে ১০ জিবিপিএস পর্যন্ত ব্যান্ডউইথ দেওয়ার ক্ষমতা আছে।

বিটিআরসির প্রতিবেদনে বেতার তরঙ্গ ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, বর্তমানে গ্রামীণফোনের ৮ কোটি ২৩ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ৪৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ, রবির ৫ কোটি ১৮ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ৪৪ মেগাহার্টজ, বাংলালিংকের ৩ কোটি ৬৫ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ৪০ মেগাহার্টজ এবং টেলিটকের ৫৯ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ২৫ দশমিক ২ মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ রয়েছে। গ্রাহক অনুপাতে বেতার তরঙ্গ বরাদ্দের এই চিত্র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে সর্বনিম্ন।

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের ঘোষণা অনুযায়ী আদর্শ মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবার জন্য প্রতি ১ মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গ সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ গ্রাহকের জন্য বরাদ্দ থাকতে হবে। কিন্তু বিটিআরসির দেওয়া তথ্য বিশ্নেষণে দেখা যায়, গ্রামীণফোন প্রতি ২০ লাখ গ্রাহকের জন্য ১ মেগাহার্টজ, রবি প্রায় ১২ লাখ গ্রাহকের জন্য ১ মেগাহার্টজ এবং বাংলালিংক প্রায় ১১ লাখ গ্রাহকের জন্য ১ মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ করেছে, যা আদর্শ মানদণ্ডের অনেক নিচে।

বিটিআরসির প্রতিবেদনে এ বিষয়ে আরও বলা হয়, চলতি বছরের মার্চ মাসে নতুন করে বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ নেয় মোবাইল অপারেটররা। এর পর গত ছয় মাসে গ্রামীণফোন ৩৮ শতাংশ সাইটে (বিটিএস), রবি ৪৬ শতাংশ সাইটে এবং বাংলালিংক ৭০ শতাংশ সাইটে নতুন বরাদ্দ পাওয়া তরঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পেরেছে।

প্রতিবেদনে মোবাইল ইন্টারনেটের জন্য ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, বর্তমানে দেশের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৯২ শতাংশ মোবাইল ইন্টারনেট সেবা গ্রহণ করছেন। এই বিপুল সংখ্যক গ্রাহককে সেবা দেওয়ার জন্য বর্তমানে মোবাইল অপারেটররা দেশে মোট ব্যবহৃত ব্যান্ডউইথের অর্ধেকেরও কম মাত্র ৪৫ শতাংশ ব্যবহার করছে। আদর্শ সেবা নিশ্চিত করতে ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের পরিমাণ সর্বোত্তম পর্যায়ে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সূত্র জানায়, গত ৩ অক্টোবর পর্যন্ত রেকর্ড অনুযায়ী পিক আওয়ারে (রাত ৮টা থেকে ১০টা) সর্বোচ্চ ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭০০ জিবিপিএস। এর মধ্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইএসপি) ব্যবহূত ব্যান্ডউইথের পরিমাণ প্রায় ১৮০০ জিবিপিএস। বাকি ৯০০ জিবিপিএস মোবাইল অপারেটরদের।

অর্থাৎ ৮ শতাংশ ব্রডব্যান্ড গ্রাহকের জন্য ১ হাজার ৮০০ জিবিপিএস এবং ৯২ শতাংশ মোবাইল গ্রাহকের জন্য ৯০০ জিবিপিএস বরাদ্দ ছিল।

বিটিএসের জন্য টাওয়ার ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, বর্তমানে দেশের মোট টাওয়ারের ৬৬ শতাংশের মালিক মোবাইল অপারেটররা। আর টাওয়ার কোম্পানিগুলোর মালিকানাধীন টাওয়ারের সংখ্যা ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। মাত্র ১৭ শতাংশ টাওয়ার শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে অন্য অপারেটররা সেবা দিচ্ছে। নেটওয়ার্কের দ্রুত বিস্তারে মোবাইল অপারেটরদের টাওয়ারগুলো শেয়ারিংয়ের জন্য উন্মুক্ত করা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে মত দেওয়া হয়।

আরো পড়ুন:

একটানা ২৪ঘন্টা ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন থাকলে বিল অর্ধেক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *