অভিমত

দেশের প্রতি ভালোবাসাই মে. জে. সি আর দত্তকে অমর করে রাখবে

তাপস হালদার:
মেজর জেনারেল সি আর দত্ত। পুরো নাম চিত্ত রঞ্জন দত্ত। তবে সি আর দত্ত নামে তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে অধিক পরিচিত। ১৯২৭ সালের ১৭ই জানুয়ারি আসামের রাজধানী শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ছিলেন পুলিশ অফিসার । মা লাবণ্য প্রভা দত্ত। স্কুল জীবন শিলংয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে পৈত্রিক নিবাসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হবিগঞ্জ সরকারী স্কুল থেকে মাধ্যমিক, খুলনার দৌলতপুর কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করে ১৯৫১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। কিছুদিন পরই সেকেন্ড লেফটেনেন্ট পদে কমিশন লাভ করেন। সৈনিক জীবনের প্রথমে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি আসালংয়ে কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে দায়িত্ব পালন করেন। হিন্দু বলে আইয়ুব খান যুদ্ধে দায়িত্ব দিতে চাননি। কিন্তু দেশপ্রেমিক সি আর দত্ত সেদিন প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আমি এই পাকিস্তানের নাগরিক, আমি হিন্দু হিসেবে যুদ্ধ করছি না, আমি যুদ্ধ করব এদেশের নাগরিক হিসেবে। সেই যুদ্ধেই অসীম বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পাকিস্তান সরকার তাঁকে পুরস্কৃত করেন।

আরও পড়ুন: শোকাবহ ২১ আগস্ট ঘাতকদের বিচারিক প্রক্রিয়ার দ্রুত বাস্তবায়ন চাই

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব সময় ছুটিতে তিনি দেশেই ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে উদ্বীপ্ত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। সেসময় তিনি সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের মেজর ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১০ই এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের অধীনে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় বীর যোদ্ধা সি আর দত্তকে। সিলেট জেলার পুর্বাঞ্চল ও খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেল লাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত অঞ্চল নিয়ে ৪ নম্বর সেক্টরটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এই এলাকায় বিভিন্ন স্থানে পূর্ব থেকেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে প্রথমে সিলেটের রসিদপুরে ক্যাম্প স্থাপন করেন তিনি। মাঝখানে বিস্তীর্ণ চা বাগানকে কাজে লাগিয়ে রণকৌশল গ্রহণ করেন। রণকৌশলের অংশ হিসেবে পরবর্তীতে ক্যাম্প মৌলভীবাজার সরিয়ে নেন। এই সেক্টরে বহু বীরত্বগাঁথা যুদ্ধে তিনি সরাসরি নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মান ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন।

১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে সীমান্ত রক্ষা বাহিনী (বিডিআর) বর্তমানে বডার গার্ড বাংলাদেশ গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে তিনিই হন প্রথম মহাপরিচালক। আজকের এই সুশৃঙ্খল বাহিনীর গর্বিত সদস্য যাঁরা আমাদের সীমান্তকে আগলে রাখেন এই বাহিনী গঠনে তার রয়েছে অসামান্য অবদান । ১৯৭৪-৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে চীফ অব লজিষ্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও বিআরটিসির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনমত গঠনের লক্ষ্যে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে এই ফোরাম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

১৯৮৮ সালের ৯ই জুন সামরিক শাসক এরশাদ স্বাধীনতার মূল চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পবিত্র সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করলে ঐ দিনই বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা করতে গঠন করেন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য তিনি লড়াই করে গেছেন।

আজন্ম স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবনের শেষ বক্তব্যও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই দিয়ে গেছেন। গত বিজয় দিবসে নিউইয়র্কে ছেলে রাজা দত্তের বাসায় যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক আলোচনা সভায় একাত্তরের স্মৃতিচারণ করে তিনি বক্তব্য দেন। এরপর আর তাঁর কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ২৫ আগস্ট ৯৩ বছর বয়সে এই বীর সেনানীর জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দসহ সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণী-পেশার মানুষ শোক প্রকাশ করেছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই বীর সন্তানকে যাতে সকলে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন সে জন্য মরদেহ যুক্তরাষ্ট্র থেকে মহামারীর মধ্যেও দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। ১লা সেপ্টেম্বর বনানী ও ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। দলমত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ অকুতোভয় এই যোদ্ধাকে শেষবারের মত শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। সি আর দত্ত এদেশের ইতিহাসের অংশ। তাঁর কখনও মৃত্যু হবে না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, মুক্তিযুদ্ধ থাকবে, তত দিনই একজন সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম সি আর দত্ত বেঁচে থাকবেন। তিনি বেঁচে থাকবেন কর্মের মধ্যমেই। দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম চিরদিন তাঁকে অমর করে রাখবে। স্বাধীনতার মহান এই বীর সন্তানের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80#gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *