স্বাস্থ্য

বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পথে : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পথে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ইতোমধ্যে কয়েকটি অনুষ্ঠানে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার দাবি করেছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় দৈনিক মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা এবং শনাক্তের হার হ্রাসের ধারাবাহিকতা গত দেড় মাস ধরে অব্যাহত রয়েছে। দৈনিক মৃতের সংখ্যা ত্রিশের নিচে এবং রোগী শনাক্তের হার চলে এসেছে ৫ শতাংশের নিচে। তবে স্বাস্থ্যবিধি পালন অব্যাহত রাখার উপর গুরুত্বারোপে করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

কোনো দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার বিষয়টি বুঝতে কয়েকটি মানদণ্ড ঠিক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর মধ্যে আছে—টানা তিন সপ্তাহ ধরে মৃত্যু ও নতুন রোগী কমতে থাকা, টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকা বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

এ বছরের ৮ মার্চের পর গত ২১ সেপ্টেম্বর এই প্রথম বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে কোভিড পজিটিভের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে আছে। ৮ মার্চ শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ শতাংশ। তবে এর পর থেকেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের হার দ্রুত বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মৃত্যু এবং গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা।

বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি:  

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী গত তিন মাসের করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে করোনায় দৈনিক মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা এবং শনাক্তের হারের উঠানামা চলে গত ১১ আগস্ট পর্যন্ত। গত ১২ আগস্টের পর করোনায় দৈনিক মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা এবং শনাক্তের হার হ্রাসের ধারাবাহিকভা ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।

করোনায় দৈনিক মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা এবং শনাক্তের হার গত পহেলা সেপ্টেম্বর ছিল যথাক্রমে ৭৯ জন, ৩০৬২ জন ও ১০.১১ শতাংশ এবং গত ২৭ সেপ্টেম্বর তা ছিল যথাক্রমে ২৫ জন, ১২১২ জন ও ৪.৩৬ শতাংশ।

গত আগস্ট মাসের করোনা পরিস্থিতিরি দিকে তাকালে দেখা যাবে, করোনায় দৈনিক মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা এবং শনাক্তের হার গত পহেলা আগস্ট ছিল যথাক্রমে ২৩১ জন, ১৪৮৪৪ জন ও ২৯.৯৭ শতাংশ এবং গত ৩১ আগস্ট ছিল যথাক্রমে ৮৬ জন, ৩৩৫৭ জন ও ১১.৯৫ শতাংশ। এর মধ্যে গত ১২ আগস্ট তা ছিল ২১৫ জন, ১০১২৬ জন ও ২২.২৬ শতাংশ। ১২ আগস্ট থেকে করোনায় মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা এবং শনাক্তের হার হ্রাসের ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে, জুলাই মাসজুড়ে ঘটে যায় করোনা পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনতি। করোনায় দৈনিক মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা এবং শনাক্তের হার গত পহেলা জুলাই ছিল যথাক্রমে ১৪৩ জন, ৮৩০১ জন ও ২৫.৯০ শতাংশ এবং গত ৩১ জুলাই ছিল যথাক্রমে ২২৮ জন, ৯৩৬৯ জন ও ৩০.২৪ শতাংশ।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো, সিএমএসডি) অ্যাম্বুলেন্স হস্তান্তর অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ভারতেও করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কমবেশি নিয়ন্ত্রণে এসেছে করোনা। তিনি বলেন, আজকে আমরা বলতে পারি করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এমনিতেই নিয়ন্ত্রণ হয় না। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রণ হয়। করোনাকালে আমাদের অনেক কাজ করতে হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান শনাক্তের হার হিসেবে আমরা করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলতে পারি। পরিস্থিতি ভালো, তবে তার মানে এই নয় যে করোনা চলে গেছে। এখন তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, মাস্ক পরছেন না। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। শুরু থেকে দেশের সংক্রমণ চিত্রে কয়েক দফা ওঠানামা দেখা গেছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর বলেছেন, করোনা শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে হলে আমরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারি। তবে, অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরা করতে হবে। যারা এখনও ভ্যাকসিন নেননি, তাদেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিনের দিতে হবে বলে জানিয়েছেন ডা. ফরহাদ মনজুর।  

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে এসেছে, তার মানে এই নয় যে সংক্রমণ বন্ধ হয়ে গেছে। এর অর্থ সংক্রমণের প্রকোপ কমেছে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময় বিভিন্ন বিধিনিষেধ, বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় ছোট ছোট উদ্যোগের ফলে সংক্রমণ আরও বেশি ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু খুব আপ্লুত হওয়ার সময় আসেনি। সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। আর সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে দ্রুত টিকা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। তাহলে সংক্রমণের আরেকটি ঢেউ এলেও টিকা অনেকটা রক্ষা করবে বলে জানান ডা. আবু জামিল ফয়সাল।

বৈশ্বিক করোনাভাইরাস সংকট নিয়ন্ত্রণে ভিন্ন ভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন রকমের পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কিভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেই বিষয়ে গবেষণা করেছে ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। সেপ্টেম্বরে ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘গভর্নিং কোভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ : রিয়ালিটিস অ্যান্ড রিফ্লেকশনস টু বিল্ড ফরোয়ার্ড বেটার’ শিরোনামের ওই গবেষণাপত্রে দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষকরা তাদের গবেষণায় তুলে এনেছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কিভাবে বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি ও সরবরাহ করা হয়েছে, সেই সঙ্গে সেখানে উঠে এসেছে কিভাবে চলমান এই মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের সংকট সমাধান করা যায়।

গবেষণায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া, লকডাউন ম্যানেজমেন্ট এবং ত্রাণ কার্যক্রম, কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক প্রণোদনা কার্যক্রম এবং তৈরি পোশাক ক্ষেত্রের পরিস্থিতি এসবও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বিস্তৃত গবেষণার একটি সমালোচনামূলক শিক্ষা হলো, বাংলাদেশের এমন একটি সংস্থার প্রয়োজন যেটা সঙ্কটের মুখোমুখি হয়ে আরও শক্তিশালী হবে। বৈশ্বিক সংকটের মতো বাংলাদেশও বারবার জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সংকটে মুখোমুখি হয়। তাই দেশের জনগণকে রক্ষার জন্য আরও ভালো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দরকার বলেই উল্লেখ করা হয় গবেষণায়। 

গবেষকরা বলেছেন, অদূর ভবিষ্যত ও দূরবর্তী ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কার্যকর মহামারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। গবেষণা শেষে বেশ কিছু সুপারিশও দিয়েছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, সরকারের উচিত দেশকে নিজের শক্তিতে গড়ে তোলা, দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে বাংলাদেশের শক্তিমত্তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা, রাষ্ট্র-সমাজ অংশীদারিত্ব এবং নাগরিক অংশগ্রহণের ঐতিহ্যকে লালন করা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সেটা নিয়ন্ত্রণে বিনিয়োগের মাধ্যমে ফাঁকগুলো দূর করতে দ্রুত কাজ করা প্রয়োজন, জিডিপি হারের বৃদ্ধির পরিবর্তে জনগণের সুরক্ষার জন্য অর্থনৈতিক নীতির পুনর্বিন্যাস করা, উন্মুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিনির্ধারক প্রক্রিয়া বিকাশের জন্য সরকারকে একবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রযাত্রার অনুশীলন করতে হবে।

আরো পড়ুন:

করোনার টিকার বাছবিচার করা ঠিক নয় যে কারণে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *