নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা ক্ষমতাবানদের দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। এমন মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। সংস্থাটি মনে করে, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত বা বাংলাদেশের অধিবাসীরা সবাই দুর্নীতি করে‘- এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। যদিও দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ- সর্বোপরি, টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে কঠিনতম অন্তরায়। ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারিতে প্রকাশিত তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করেছে টিআইবি।
শুধু একটি আইন বা দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। এজন্য সমাজের সর্বস্তরের নাগরিকের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন বলে জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। আজ বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উদযাপন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে তারা যেন অংশীজন হয়, এ দায়িত্ব মানুষের মধ্যে সৃষ্টির লক্ষ্যে দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করা হয়। আজকে আমরা সরকারিভাবে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসটি পালন করছি। দেশের সব বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এতে প্রশাসন, সুশীল সমাজ, ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জনগণ অংশ নেবে। ঢাকায় আটটি জায়গায় মানববন্ধন হবে। একইভাবে দেশের সব জেলা-উপজেলায় মানববন্ধন হবে। এর উদ্দেশ্য জনগণকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন করা।
তিনি বলেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অনুসন্ধান ও তদন্তে যে দীর্ঘসূত্রতা আছে, ওটা কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে পরিকল্পনা করা। আমরা বাস্তবভাবে পরিকল্পনা করছি দুর্নীতি নিয়ে জনগণের যে প্রত্যাশা, এর কাছাকাছি যাওয়ার।
দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে সরকার:
দেশের বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মনে করেন, দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থানে আগে থেকেই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ করে চলতি মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই নির্বাচনি ইশতেহারের ‘দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সচেষ্ট আছেন তিনি। সরকার ও দলের মধ্যেও এমন নীতির প্রতিফলন ঘটান তিনি। আগে থেকে চলে আসা সন্ত্রাস ও মাদকবিরোধী অভিযানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার হয়ে ওঠে।’
পেশাজীবি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আরও জানান, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতেই এগিয়ে চলছে বর্তমান সরকারের কার্যক্রম। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশনায় দেশজুড়ে চলছে দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান। যত প্রভাবশালী এবং সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের যত ঘনিষ্ঠই হোন না কেন, ছাড় পাচ্ছেন না কোনো অপরাধীই। কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নিতেও নারাজ সরকার ও দল। সরকারের এই কঠোর অবস্থান সুধী সমাজসহ সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সময়ের বক্তৃতা-বিবৃতিগুলোতেও অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির প্রতিফলন রয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
করোনা সংকট শুরুর পর থেকে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলার পাশাপাশি কঠোর হস্তে অনিয়ম-দুর্নীতি দমনে জোর দেন তিনি। দেশের কয়েকটি স্থানে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে দলের কয়েকজন নেতা ও জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নেয়া হয়। করোনাকালে দুর্নীতির জন্য স্বাস্থ্য খাতের কয়েকজন হর্তাকর্তার বিরুদ্ধেও নানা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। করোনাকালে ত্রাণ তৎপরতায় যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদেরও তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করে কঠোর বার্তা দিয়েছে সরকার। অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। সর্বোপরি দেশব্যাপী দূনীতি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
দুর্নীতির ধারণা দুই ধাপ নীচে নেমে এসেছে বাংলাদেশ : টিআইবি
দুর্নীতির ধারণা সূচকে আগের বছরের তুলনায় আরো দুই ধাপ নীচে নেমে এসেছে বাংলাদেশ। বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২০’ এর বৈশ্বিক প্রকাশ উপলক্ষে ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সিপিআই ২০২০ অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার নীচের দিক থেকে বাংলাদেশ ১২তম অবস্থানে আছে। যেটা সিপিআই-২০১৯ এর তুলনায় দুই ধাপ নীচে নেমেছে বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৯ সালে নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪ তম। এর পেছনে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টিকে অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীনতা, মতপ্রকাশ ও জবাবদিহিতার অভাবকে অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি।
টিআইবি’র দুর্নীতি সূচক এবং ব্যাখ্যা সঠিক নয়: দুদক
দুর্নীতি দমন কমিশনের(দুদক) দাবি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই সূচক এবং ব্যাখ্যা সঠিক নয়। টিআইবি’র প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর পরই সংস্থাটির কমিশনার মোজাম্মেল হক খান সাংবাদিকদের বলেন, দুদকের কাজের প্রতি বাংলাদেশের ৬৮ ভাগ মানুষ তাদের আস্থা প্রকাশ করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ এতোটা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে সাম্প্রতিককালের উন্নয়ন কাজে এতোটা সাফল্য পেতো না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে জরিপ পরিচালনা করলে টিআই এর এমন প্রতিবেদন টিকবে না, প্রত্যাশা বেশি হওয়ার কারণে তাদের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসছে।
দুদকে অভিযোগের সংখ্যা কমেছে :
দুদক সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে দুদকে মোট ১১ হাজার ৮২৮টি অভিযোগ জমা পড়ে; অর্থাৎ মাসে জমা পড়েছে গড়ে ১ হাজার ১৮৩টি অভিযোগ। ২০২০ সালে মাসে গড়ে ১ হাজার ৫৪১টি অভিযোগ জমা পড়েছিল ওই বছর মোট জমা হওয়া অভিযোগের সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৪৮৯। এদিকে ২০২০ সালে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৪৮৭টি অভিযান পরিচালনা করে। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে সংখ্যাটি নেমেছে ১১১-তে।
আরো পড়ুন: