বিশেষ প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: করোনা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকায় সারাদেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণাকে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে অসংখ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়িত হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ চলছে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ইতোমধ্যে ঘোষিত নির্দেশনাসমূহ শিথিল করেছিল সরকার। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার প্রতিযোগিতা বেশ চোখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটি। স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে পালন না করার কারণেই সারাদেশে কঠোর লকডাউনের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার (২৬ জুন) স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৪ হাজার ৫৩ জনের। নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৩৩৪ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ১৩৮ জনে। মৃত ৭৭ জনের মধ্যে পুরুষ ৪৮ জন ও ২৯ জন নারী। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯০ দশমিক ৬৮ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা :
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে আগামী বৃহস্পতিবার ১ জুলাই থেকে সাত দিন সারাদেশে কঠোর লকডাউন আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ) শেখ রফিকুল ইসলাম এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘আগামী ১ জুলাই থেকে সারাদেশে কঠোর লকডাউন কার্যকর থাকবে। যেহেতু জুন মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেহেতু সিদ্ধান্তটি ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে জানান অতিরিক্ত সচিব।
এর আগে, গতকাল সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে আগামী ২৮ জুন সোমবার থেকে সাত দিন সারাদেশে কঠোর লকডাউন আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ওই তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, লকডাউনে জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। জরুরি পণ্যবাহী যানবাহন ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। কেবল অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে যানবাহন চলাচল করতে পারবে।
লকডাউনের বিকল্প নেই : বিশেষজ্ঞগণ
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ ধূমকেতু ডটকমকে জানান, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ইতোমধ্যে গৃহীত নানা উদ্যোগ এবং সেগুলোর সার্বিক চিত্র পর্যালোচনা করে সারাদেশে কমপক্ষে ১৪ দিনের ‘শাটডাউন’ জারির সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটি। তিনি বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি চলছে। করোনা ভাইরাসের বিশেষ করে ডেলটা প্রজাতির সামাজিক সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে ও দেশে ইতোমধ্যেই রোগের প্রকোপ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের জীবাণুর সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে সারা দেশেই উচ্চ সংক্রমণ এবং ৫০টিরও বেশি জেলায় অতি উচ্চ সংক্রমণ লক্ষ করা যায়। কিন্তু করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য খণ্ড খণ্ডভাবে নেওয়া কর্মসূচির উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
অধ্যাপক সহিদুল্লাহ আরও জানান, অন্যান্য দেশ, বিশেষত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এর বিস্তৃতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে । তাদের মতামত অনুযায়ী, যেসব স্থানে পূর্ণ শাটডাউন প্রয়োগ করা হয়েছে, সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ও জনগণের জীবনের ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সারা দেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ শাটডাউন দেওয়ার সুপারিশ করছে। জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস-আদালতসহ সবকিছু বন্ধ রাখা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে না পারলে আমাদের যত প্রস্তুতিই থাকুক না কেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়বে বলেও বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদু্ল্লাহ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডীন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ধূমকেতু ডটকমকে জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন কখনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এতে দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিশেষ করে অথনৈতিক অবস্থা অসহনীয় হুমকিতে পড়তে পারে। কিন্ত দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার প্রতিদিন বাড়ছে। ইতোমধ্যে শনাক্তের হার বেড়ে প্রায় ২২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। হাসপাতালে দেখা দিয়েছে আইসিইউ ও সাধারণ কোভিড রোগীদের চিকিৎসা সংকট। এমন পরিস্থিতিতে লকডাউন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। চারটি শর্ত পালন করলে লকডাউনের প্রয়োজন হতো না। সেগুলো হলো- সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি সর্বতোভাবে পালন করা এবং সবার করোনার টিকা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। তবে লকডাউন কার্যকর করার আগে নিম্নআয় ও দিনমজুর শ্রেণীর মানুষদের দিনাতিপাতের বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, টিকার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশে করোনা সংক্রান্ত মৃত্যু হার কমাতে কোনো ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শিথিলতার স্থান রাখার সুযোগ নেই। এখন যদি এসব বিধি-বিধান কঠোরভাবে পালন করা না হয় তাহলে সংক্রমণের হার এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমানো কঠিন হয়ে যাবে। এমনকি পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠতে পারে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস বজায় রাখতে হবে। অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাঘুরি বন্ধ রাখতে হবে। বাইরে বের হলেও অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে এবং অধিক লোকসংখ্যা রয়েছে এমন পরিবেশ এড়িয়ে চলতে হবে।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেন, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নিতে পারে। এর সঙ্গে সারা দেশে ব্যাপক হারে জনসচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে পোস্টার লিফলেট বিতরণ করতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করে সচেতনতা কর্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসনকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, জনগণ ও প্রশাসনের যৌথ অংশগ্রহণ ছাড়া এই কঠিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
সারাদেশে সর্বাত্মক লকডাউন দেয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, দেশে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে অসংখ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়িত হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ চলছে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে শনাক্তের হার বেড়ে প্রায় ২২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশেষ করে অথনৈতিক অবস্থার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা শিথিল করেছিল সরকার। ঘোষণা দিয়েছিল বিচ্ছিন্ন লকডাউনের। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার চিত্র বেশ চোখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটি। স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে পালন না করার কারণেই সারাদেশে লকডাউনের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।