অভিমত

দুর্গাপূজা : বাঙালির সার্বজনীন প্রাণের উৎসব

তাপস হালদার :

দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। সমগ্র হিন্দু সমাজেই প্রচলিত থাকলেও বাঙালিদের মধ্যে দুর্গাপূজা বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ বিশ্বের যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই জাঁকজমকের সাথে পালিত হয় দুর্গাপূজা।

দুর্গোৎসব আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথি থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। তবে পূজার সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন মহালয়া থেকে আর শেষ হয় পরবর্তী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী পূজার মধ্য দিয়ে।

দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কুমারী পূজা।সাধারণতঃ দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে কুমারী পূজা হয়ে থাকে। শাস্ত্র মতে, এক থেকে ষোল বছর বয়সী অবিবাহিত কন্যাকে মাতৃরূপে কুমারী পূজা করা হয়। ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ নারী জাতিকে দেবীর আসনে সম্মানিত করার জন্যই কলকাতার বেলুড় মঠে ৯ জন কুমারীকে পূজার মধ্য দিয়ে ‘কুমারী পূজা’র পুনঃপ্রচলন করেন। তারপর থেকে ‘কুমারী পূজা’ দুর্গাপূজার অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

দুর্গাপূজার অন্যতম একটি বিশেষ অধ্যায় হল সন্ধিপূজা। অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে এই পূজা হয়ে থাকে বলে একে সন্ধিপূজা বলা হয়। অষ্টমী তিথির শেষ চব্বিশ মিনিট থেকে নবমী তিথির প্রথম চব্বিশ মিনিট পর্যন্ত সময়ে এই পূজা হয়ে থাকে। সন্ধি পূজার মাহেন্দ্রক্ষণেই দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। সেজন্য শাস্ত্রমতে, সন্ধি পূজা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

শরৎকালে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে রামায়ণের যুগ থেকে। রাজা রামের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যায় রাক্ষস রাজা রাবণ। সেখান থেকে উদ্ধারের জন্য রাজা রাম দেবী দুর্গাকে ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে পূজা করেছিলেন। অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন ঘটেছিল বলে শরৎকালের দুর্গাপূজাকে অকালবোধনও বলা হয়। বসন্তকালের দুর্গাপূজাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা।

দুর্গাপূজা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। ধনী বা বনেদী পরিবারগুলোতে যে পূজা আয়োজন করে তাকে বলে পারিবারিক পূজা। অন্যদিকে যৌথভাবে বা এলাকা ভিত্তিক পূজাকে বলা হয় সর্বজনীন বা বারোয়ারি পূজা।

দুর্গাপূজার এই সার্বজনীনতা দেবী দুর্গা প্রতিমার মধ্যেও দেখা যায়। অন্যসব দেবতারা এককভাবে পূজিত হন। কিন্তু দেবী দুর্গা পূজিত হন সমষ্টিগতভাবে। এখানে তার সঙ্গে আছেন সিদ্ধিদাতা গণেশ, দেবাদি সেনাপতি কার্তিক, জ্ঞানের দেবী সরস্বতী ও ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী।

দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি সার্বজনীন উৎসব। দুর্গোৎসবে দুইটি পর্ব। একটি হল পূজা, যেটি সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষ পালন করে থাকে। অন্যটি হল উৎসব, যা জাতি, ধর্ম, শ্রেণী, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়েছে। উৎসব উপভোগের ক্ষেত্রে নেই কোনও ভেদাভেদ।

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে বসবাসরত হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মাবলম্বীরা স্ব-স্ব রীতি-নীতি ও প্রথানুসারে ধর্মীয় উৎসব পালন করে। বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজা পুরো পৃথিবীর জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তারপরও ক্ষুদ্র একটি অংশ মাঝে মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন নষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি ছড়ানোই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু বর্তমান সরকারের এসব ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের ফলে উগ্রপন্থিরা মাথাচাড়া দিতে পারে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সুস্পষ্টভাবে বারংবার বলেছেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশে সে পরিস্থিতিটাই তৈরি হয়েছে। ঈদ ও পূজা এখন কেবল বিশেষ কোনও ধর্মের উৎসব নয়। সমগ্র বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।

মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী দেবী। তিনি মানবসমাজের সকল দুর্গতি দূর করে থাকেন। আজকের দিনে মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা- দেশ থেকে সকল অশুভ শক্তিকে বিনাশ করে একটি সুন্দর, শান্তিময়, কল্যাণকর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করো।

সকলকে শারদীয় শুভেচ্ছা।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

আরো পড়ুন:

প্রতিটি মন্দিরে থাকবে সাবান-পানি, প্রয়োজনে থার্মাল স্ক্যানার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *