নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: দেশে সীমিত পরিসরে লিভার প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চলছে। অর্থ, যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে দেশে পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলেন, পূর্ণাঙ্গ সেন্টার না থাকায় লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে রোগীকে বিদেশে পাড়ি দিতে হয়। দেশি-বিদেশি হাসপাতালগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশে এ পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকজন রোগীর লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
লিভার প্রতিস্থাপনে কয়েকবার সফলতার মুখ দেখেছে বাংলাদেশ। তবে প্রতিটি লিভার প্রতিস্থাপনে একক কোনো হাসপাতালের কৃতিত্ব নেই। বারডেম, ল্যাবএইড ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত মোট ৫ জন রোগীর লিভার প্রতিস্থাপন করানো হয়েছে। এই পাঁচটি প্রতিস্থাপন কাজের মধ্যে তিনটিই হয়েছে বারডেম হাসপাতালে।
বাংলাদেশে লিভার প্রতিস্থাপনের পথিকৃৎ হলেন বারডেম হাসপাতালের হেপাটো বিলিয়ারি প্যানক্রিয়াটিক ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন, অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী। ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের লিভার প্রতিস্থাপন কেন্দ্র থেকে তিনি ফেলোশিপ পান।
তিনি ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, লিভার প্রতিস্থাপনে দক্ষ জনবল এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। বারডেম হাসপাতালে ১৯৯৯ সালে প্রথম হেপাটো-বিলিয়ারি-প্যানক্রিয়াটিক সার্জারি শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দীর্ঘদিন লিভার অস্ত্রোপচার কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনার পর ২০১০ সালের জুন মাসে বারডেম হাসপাতালে বাংলাদেশে প্রথম সফল লিভার প্রতিস্থাপন সম্পূর্ণ করা হয়। দ্বিতীয় সফল অস্ত্রোপচার ঘটে ২০১১ সালের আগস্টে। আমি ওই সার্জারি টিমের নেতৃত্বে ছিলাম।
বারডেম হাসপাতাল ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে একটি উৎকর্ষমূলক লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার তৈরির কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। বর্তমানে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিটটি ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিট হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
লিভার প্রতিস্থাপনের নানা দিক তুলে ধরে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, জীবিত ব্যক্তির লিভারের একটি অংশ দান হচ্ছে একটি পবিত্র এবং মহামূল্যবান উপহার। রক্তদানের মতোই একে একটি আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। তবে রক্তের মতো এ জন্য ব্যাংক করা যাবে না। একই সময়ে দুই ওটিতে দাতা ও গ্রহীতার অস্ত্রোপচার চলে। লিভার দানে মানুষকে সচেতন করতে মিডিয়া সব থেকে কার্যকর ও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের জানাতে হবে, দান করার পর দাতার অবশিষ্ট লিভার তার দেহের চাহিদা অনুযায়ী বাড়তে থাকে। মাত্র ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে লিভার তার আগের সম্পূর্ণ কর্মক্ষমতা ফিরে পায় এবং দাতা তার আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যান। প্রতিস্থাপিত লিভারও গ্রহীতার দেহে অনুরূপভাবে খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। দেহের গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য, একটি নতুন কেন্দ্রীয় অঙ্গের মতোই চাহিদা অনুযায়ী কাজ করে থাকে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়স্ক কোনো সুস্থ ব্যক্তির রক্তের গ্রুপ গ্রহীতার রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিললেই তিনি তার লিভারের একটি অংশ ওই ব্যক্তিকে দান করতে পারবেন। সুস্থ ব্যক্তি তার লিভারের একটি অংশ (ডান অথবা বাঁ দিক) কোনো নিকট আত্মীয়কে দান করতে পারেন। এমনকি কারও ব্রেন ডেথ বা জীবন রক্ষাকারী সাপোর্টসমূহ সরিয়ে নেওয়ার পরের অবস্থায় তার নিকট আত্মীয়র অনুমতি সাপেক্ষে লিভার অপসারণ করে তা প্রতিস্থাপন করা যাবে। জরুরি ক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপ না মিললেও ‘এবিও ইনকমপেটেবল’ দাতা হিসেবেও লিভার দান করা যায়। তবে খুব বেশি ব্যয়বহুল হবে।
প্রতিস্থাপন ব্যয়ের বিষয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমাদের দেশে লিভার প্রতিস্থাপন করতে রোগীরই খরচ পড়ে ২০-২৫ লাখ টাকা (শুধু চিকিৎসা, অপারেশন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা)। তবে সব মিলিয়ে রোগীর প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ হবে। যা দেশের বাইরে প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয়। সারা বিশ্বেই লিভার প্রতিস্থাপন একটি ব্যয়বহুল জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত বারডেম হাসপাতাল এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিট তুলনামূলক কম খরচে লিভার প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ধূমকেতু হলো, বাংলাদেশে লিভার প্রতিস্থাপনের এই নবযুগের সূচনায় লিভার প্রতিস্থাপনের খরচ ২০ লাখ টাকার কাছাকাছি টাকা রাখা যায় কি না, সেই চিন্তা চলছে। সরকারও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছে। তারা এ পর্যন্ত বারডেমের এই সেন্টারকে প্রায় ৮ কোটি টাকা দিয়েছে। বারডেম খরচ করেছে ১২ কোটি টাকার বেশি। আশা করা যায়, ব্যক্তি বা বেসরকারি খাত থেকে বড় কোনো অনুদান এলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে লিভার প্রতিস্থাপন আমরা আরও কম খরচে করতে পারব।
অধ্যাপক বলেন, লিভার প্রতিস্থাপনের সব থেকে বড় বাধা ডোনার। রোগীরা ডোনার ম্যানেজ করতেই হিমশিম খায়। লিভারের রোগীদের আত্মীয়রা ডোনার হিসেবে এগিয়ে আসলে এ কাজ আরও সহজ হবে। বাংলাদেশের লিভার ফেইলিয়ারে আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষ, সাশ্রয়ী মূল্যে তার জীবন রক্ষাকারী শেষ চিকিৎসা হিসেবে নিজ দেশে লিভার প্রতিস্থাপনের সুফল পেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ধূমকেতু ডটকমকে জানান, নানা কারণে লিভার রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে হেপাটাইটিস ভাইরাস হচ্ছে লিভারের প্রধান শত্রু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিশ্বের প্রায় ২শ’ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত, যা মোট জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ। প্রতিবছর হেপাটাইটিসজনিত রোগে বিশ্বের প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই জানে না তারা ভাইরাসটিতে আক্রান্ত। এভাবে নিজের অজান্তেই আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাসটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। আর শরীরে থাকা ভাইরাসটি যে কোনও সময় সক্রিয় হয়ে আক্রান্তকারীকে মেরে ফেলতে পারে বা তাকে শারীরিকভাবে অক্ষম করে ফেলতে পারে।
তিনি বলেন, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ, তা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী এ রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত কম। এমনকি স্বাস্থ্যকৌশল প্রণয়নকারী দফতরগুলোও এ ব্যাপারে উদাসীন। লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের জন্য প্রধানত দায়ী হেপাটাইটিস। রোগটি বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার সামর্থ্য রাখে। পাঁচ ধরনের ভাইরাস হেপাটাইটিস রোগটির জন্য দায়ী। এগুলোকে ইংরেজী এ, বি, সি, ডি এবং ই দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো সাধারণত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের মাধ্যমে, যৌনবাহিত হয়ে বা আক্রান্তের শরীরে কোনও তরলের সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে।
পাঁচটি ভাইরাসের মধ্যে ‘বি’ ভাইরাসটি সবচেয়ে সাধারণ। ভাইরাসটি আক্রান্ত মায়ের শরীর থেকে নবজাতক বা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মধ্যে বাহিত হতে পারে। এছাড়া দূষিত সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীদের মাঝে ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে।
‘ই’ ভাইরাসটি সাধারণত দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। ডব্লিউএইচও’র মতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হেপাটাইটিস ছড়িয়ে পড়ার জন্য ‘ই’ ভাইরাসটি প্রধানত দায়ী। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতেও এর সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও।
‘এ’ ও ‘বি’ ভাইরাসের কার্যকর ভ্যাকসিন বাজারে পাওয়া যায়। এটি ‘ডি’র সংক্রমণেও ব্যবহার করা যায়, আর ‘ই’ ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি হলেও এখনও সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। ‘সি’ ভাইরাসের কোনও ভ্যাকসিন এখনও তৈরি করা যায়নি। প্রাথমিক অবস্থায় লিভারের কোনও রোগ ধরা পড়লে তা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অনেকের জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে। কারও হেপাটাইসিস ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাস থাকলে এবং সময়মতো তা প্রতিরোধ না করলে ধীরে ধীরে লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সারে রূপ নেয়। এ ধরনের রোগীদের শেষ চিকিৎসাই হচ্ছে লিভার প্রতিস্থাপন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয়, এ্যান্ড স্টেজ লিভার ডিজিজ। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে অনেক আগে থেকেই লিভার প্রতিস্থাপন হচ্ছে। আমাদের দেশেও লিভার প্রতিস্থাপন সম্ভব। তবে লিভার প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এখনও যে বাধাগুলো আমাদের রয়েছে তার মধ্যে প্রথমত হচ্ছে যন্ত্রপাতি। এ জন্য যেসব যন্ত্রপাতি লাগে সেগুলোর দাম কোটি কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়:
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালের ২৪ জুন মায়ের লিভারের আংশিক সংগ্রহ করে তার ছেলের শরীরে প্রতিস্থাপন শুরু করা হয়। রোগীর লিভার সম্পূর্ণ ফেলে দিয়ে দাতার লিভারের অংশ সফলভাবে প্রতিস্থাপিত করতে ৫০ সদস্যের চিকিৎসক দল টানা ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। এই অপারেশনে মোট ২০ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন হয়। এতে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোবিলিয়ারি, প্যানক্রিয়েটিক ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুলফিকার রহমান খান।
বারডেম:
দেশের প্রথম লিভার প্রতিস্থাপন করানো হয় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে। এ পর্যন্ত এই হাসপাতালে প্রতিস্থান করা হয়েছে তিন রোগীর লিভার। ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৩০ সদস্যের একটি চিকিৎসক দল সফলভাবে লিভার প্রতিস্থাপন করেন। ১১ ঘণ্টার জটিল এই অপারেশনে নেতৃত্ব দেন বারডেমের অরগ্যান ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, আমরা যদি কোনো ধরনের পারিশ্রমিকও না নিই; প্রতিষ্ঠানও কোনো ধরনের খরচ না নেয়; এরপরও ২০-২৫ লাখ টাকার খরচ চলে যাবে। অনেকের পক্ষে এই টাকা জোগাড় করা সম্ভব না।
আরো পড়ুন:
বিএসএমএমইউতে ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগ খোলার সিদ্ধান্ত || বাংলাদেশে লিভার চিকিৎসায় মাইলফলক