প্রচ্ছদ

তালেবান ইস্যুতে সন্দেহের দোলাচলে পাক-মার্কিন সম্পর্ক

ডেস্ক রিপোর্ট, ধূমকেতু বাংলা: আফগান যুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির যতই পার্থক্য থাকুক, দুই পক্ষের কেউই একে অপরকে পুরোপুরি পরিহার করতে পারবে না। কারণ ভূরাজনীতি এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এমনই। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আগে তালেবানের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘ আলোচনা করতে হয়েছে, যাতে মধ্যস্হতাকারী ছিল পাকিস্তান।

চলতি বছর আগস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর পাক-মার্কিন সম্পর্কের একটি দুর্বল দিক আবার উন্মোচিত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা নিয়ে অভিযোগ আসে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেই। অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই যুদ্ধে তাদের অবদান ও ত্যাগের স্বীকৃতির প্রশ্নটি সামনে আসতে থাকে। অনেকের মনে প্রশ্ন ওঠে ওয়াশিংটন-ইসলামাবাদ সম্পর্কে কি তাহলে চিড় ধরতে যাচ্ছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কি তাহলে পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে, কংগ্রেস সদস্যদের এরকম এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিনকেন সম্প্রতি বলেন, ‘এটি এমন একটি বিষয় যা নিয়ে আজ হোক কাল হোক আমাদের ভেবে দেখতে হবে। গত ২০ বছরে পাকিস্তানের ভূমিকা যা ছিল, আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আগামী দিনগুলোতে তাদের ভূমিকা কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসে গেছে।’

ব্লিনকেনের বিবৃতিটি এমন এক সময় এলো যখন পাকিস্তান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের কাজ ও ত্যাগের স্বীকৃতির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে সরব হয়েছে। পাকিস্তান চায় যুক্তরাষ্ট্র যেন দেশটিকে অন্য গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদেশের মতো মর্যাদা দেয়।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কয়েক মাস আগে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দেশের সম্পর্কে এক ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, তারা পাকিস্তানকে আর্থিক সহায়তা দিয়েই চলেছে তাই পাকিস্তানের উচিত বিনিময়ে তাদের জন্য কাজ করা।’

পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি মে মাসে তার মার্কিন প্রতিপক্ষ ব্লিনকেনকে বলেছিলেন, ‘ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং একটি শান্তিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ার মতো অভিন্ন কিছু দৃষ্টিভঙ্গির ওপর পাকিস্তান দুদেশের সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী’।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ধারণাটি জনপ্রিয়। দেশটির রাজনৈতিক নেতারা চান, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমমর্যাদা অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দিক। ব্লিনকেনের সর্বশেষ ঐ বিবৃতি আসার পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলের পাশাপাশি সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। সব শেষ ইসলামাবাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্লিনকেনের ঐ মন্তব্য পারস্পরিক সহযোগিতার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে না।

ইতিহাস বলে, পাক-মার্কিন সম্পর্ক সবসময় সরল রেখায় চলেনি, পেন্ডুলামের মতো সময় সময় দোলাচাল তৈরি হয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে দুদেশের মধ্যে প্রথম সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়| ঐ সময় ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রতা মার্কিন মিত্রদের কাছে নিরাপত্তা হুমকি বিবেচিত হতো। তাই ঐ সময় ভূরাজনৈতিক কারণে ইসলামাবাদ ওয়াশিংটনের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায়।

৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ঐ হুমকি দূর হয়। ফলে পাকিস্তানের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কমে আসে। ২০০০-এর প্রথমে দশকে ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে পাক-মার্কিন সম্পর্ক আবার কাছাকাছি চলে আসে। চলতি বছর আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গুটানোর পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য থেকে স্পষ্ট দুদেশের সম্পর্ক সম্ভবত আগের জায়গায় নেই। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ধরে এগোয়নি, তাত্ক্ষণিক প্রয়োজনই প্রাধান্য পেয়েছে।

পাকিস্তান যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন সময় ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে তার ফলে দেশটি আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছে। তবে এই উপকারের সিংহভাগই ভোগ করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। বেসামরিক প্রশাসন সেভাবে লাভবান হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানের দাবি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে তাদের চড়া মূল্য গুনতে হয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র অন্তত স্বীকার করে নিক। যুক্তরাষ্ট্র যে আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা দিয়েছে তা মূলত তাদের এই যুদ্ধেই ব্যয় হয়েছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি দেখছে ভিন্ন দৃষ্টিতে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগান যুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ায় হতাশ হয়ে একসময় বলেই ফেলেছিলেন যে, ‘পাকিস্তানকে আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়েছি, কিন্তু তারা সেই অর্থ দিয়ে আফগানিস্তানে আমরা যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি তাদেরই আশ্রয় প্রশয় ও সহযোগিতা করছে।‘

তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তখনকার পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আমরা পাইনি। ওয়াশিংটন যে অর্থ দিয়েছে সেটি আফগানিস্তানে মার্কিন ও বহুজাতিক জোটকে দেওয়া সেবার বিনিময় কিছু কিছু আর্থিক সহযোগিতা মাত্র। যা পাকিস্তান ঐ কাজে ব্যয় করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আফগান যুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির যতই পার্থক্য থাকুক, দুই পক্ষের কেউই একে অপরকে পুরোপুরি পরিহার করতে পারবে না। কারণ ভূরাজনীতি এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এমনই। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আগে তালেবানের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘ আলোচনা করতে হয়েছে যাতে মধ্যস্হতাকারী ছিল পাকিস্তান। সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও মধ্যস্হতার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে ইসলামাবাদকে। আফগানিস্তানে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। তাই দুদেশের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হলেও তা ভেঙে পড়ার মতো অবস্হা তৈরি হয়নি।

আরো পড়ুন:

চালু হলো চীন-লাওস ট্রেন চলাচল

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *