ধর্ম ও জীবন ডেস্ক, সুখবর ডটকম: ১৪৪৪ হিজরির রমজান মাসের নবম তারাবিহ আজ। আজকের তারাবিহতে সুরা হুদের ৬-১২৩ আয়াত এবং সুরা ইউসুফের ১-৫২ আয়াত তেলাওয়াত করা হবে। নবী পরিবারের ব্যক্তিদের মধ্যে যারা অবাধ্য বা দোষী তাদের জন্যও কোনো ছাড় ছিল না। হজরত নুহ আলাইহিস সালামের সময় সংঘটিত মহাপ্লাবনের ঘটনার বর্ণনা পড়া হবে আজকের তারাবিহতে।

সুরা দুটিতেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে। সে সঙ্গে ১২তম পারার তেলাওয়াত শেষ হবে।

সুরা হুদ ও সুরা ইউসুফের আলোচনার সংক্ষিপ্ত বিষয় তুলে ধরা হলো-

পয়গাম্বর নুহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে না জানা বিষয়ের ভুল থেকে বাঁচতে এভাবে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করেছিলেন-

رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَإِلاَّ تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُن مِّنَ الْخَاسِرِينَ

‘হে আমার পালনকর্তা! আমার যা জানা নেই এমন কোনো দরখাস্ত করা হতে আমি আপনার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৪৭)

সুরা হুদ (০৬-১২৩)

সুরা হুদে আগের সব জাতির ওপর আপতিত আল্লাহর গজব ও বিভিন্ন কঠিন আজাব, পরকালের ভয়াবহ ঘটনাবলী, পুরস্কার ও শাস্তির বিশেষ বর্ণনা রয়েছে। এ সুরায় উল্লেখিত হয়েছে বিশেষ ঘটনাপ্রবাহ আজকের তারাবিহতে পড়া হবে।

যে আয়াত দ্বারা আজকের তারাবিহ শুরু হবে তাতে মহান আল্লাহ যে মানুষের জীবিকার দায়িত্ব নিয়েছেন সে ঘোষণা এসেছে এভাবে। আল্লাহ বলেন-

وَ مَا مِنۡ دَآبَّۃٍ فِی الۡاَرۡضِ اِلَّا عَلَی اللّٰهِ رِزۡقُهَا وَ یَعۡلَمُ مُسۡتَقَرَّهَا وَ مُسۡتَوۡدَعَهَا ؕ کُلٌّ فِیۡ کِتٰبٍ مُّبِیۡنٍ

‘আর পৃথিবীতে কোনো বিচরণশীল নেই, তবে সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন, তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছুই এক সুবিন্যস্ত কিতাবে রয়েছে।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৬)

রিজিকের আভিধানিক অর্থ এমন বস্তু যা কোনো প্রাণী আহার্যরূপে গ্রহণ করে, যার দ্বারা সে দৈহিক শক্তি সঞ্চয়, প্রবৃদ্ধি সাধন এবং জীবন রক্ষা করে থাকে। রিজিকের জন্য মালিকানা স্বত্ব শর্ত নয়। সকল জীবজন্তু রিজিক ভোগ করে থাকে কিন্তু তারা তার মালিক হয় না। কারণ, মালিক হওয়ার যোগ্যতাই ওদের নেই। অনুরূপভাবে ছোট শিশুরাও মালিক নয়, কিন্তু ওদের রিজিক অব্যাহতভাবে তাদের কাছে পৌছতে থাকে। (কুরতুবি)

এমন সব প্রাণীকে دابة বলে যা ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করে। পক্ষীকুলও এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ, খাদ্য গ্রহণের জন্য তারা ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করে থাকে এবং তাদের বাসস্থান ভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন হয়ে থাকে সামুদ্রিক প্রাণীসমূহ ও পৃথিবীর বুকে বিচরণশীল। কেননা, সাগর-মহাসাগরের তলদেশেও মাটির অস্তিত্ব রয়েছে। মোটকথা, সমুদয় প্রাণীকুলের রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই গ্রহণ করছেন। এবং একথা এমনভাবে ব্যক্ত করেছেন যদ্বারা দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দেশ করা যায়। ইরশাদ হয়েছে- ‘তাদের রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর উপর ন্যস্ত’।

একথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ তাআলার উপর এহেন গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার মত কোনো ব্যক্তি বা শক্তি নেই, বরং তিনি নিজেই অনুগ্রহ করে গ্রহণ করে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন। আর এক পরম সত্য, দাতা ও সর্বশক্তিমান সত্তার ওয়াদা যাতে নড়চড় হওয়ার অবকাশ নেই।

মোটকথা, মহান আল্লাহ রুযীর যিম্মাদার ও দায়িত্বশীল। ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী সকল সৃষ্টিজীব, মানুষ হোক বা জীন, পশু হোক বা পক্ষীকুল, ছোট হোক বা বড়, জলচর হোক বা স্থলচর; মোটকথা, তিনি সমুদয় প্রাণীকে তার প্রয়োজন মত জীবিকা দান করেন।

পরের আয়াতে সুবিন্যস্ত আসমান-জমিন সৃষ্টির বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আরশের অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে। আবার মানুষের মধ্যে যারা নেক আমল করে তাদের পরীক্ষা করার বিষয়টিও ওঠে এসেছে এ আয়াতে। আল্লাহ বলেন-

وَ هُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ وَّ کَانَ عَرۡشُهٗ عَلَی الۡمَآءِ لِیَبۡلُوَکُمۡ اَیُّکُمۡ اَحۡسَنُ عَمَلًا ؕ وَ لَئِنۡ قُلۡتَ اِنَّکُمۡ مَّبۡعُوۡثُوۡنَ مِنۡۢ بَعۡدِ الۡمَوۡتِ لَیَقُوۡلَنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اِنۡ هٰذَاۤ اِلَّا سِحۡرٌ مُّبِیۡنٌ

‘তিনিই আসমান ও জমিন ছয় দিনে তৈরি করেছেন, তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে, তিনি তোমাদের পরীক্ষা করতে চান যে, তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে ভালো কাজ করে। আর যদি আপনি তাদের বলেন যে, নিশ্চয়ই মৃত্যুর পরে তোমাদের জীবিত ওঠানো হবে, তখন কাফেররা অবশ্য বলে এটা তো স্পষ্ট জাদু!’ (সুরা হুদ : আয়াত ৭)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর ডান হাত পরিপূর্ণ, দিন-রাত খরচ করলেও তা কমে না। তোমরা কি দেখ না যে, আসমান ও জমিনের সৃষ্টির সময় থেকে আজ পর্যন্ত তিনি কত বিপুল পরিমাণে খরচ করেছেন? তবুও তার ডান হাতের কিছুই কমেনি। আর তার আরশ পানির উপর অবস্থিত ছিল। তাঁর অন্য হাতের রয়েছে ইনসাফের দাঁড়িপাল্লা, সে অনুসারে বৃদ্ধি-ঘাটতি বা উন্নতি অবনতি ঘটান। (বুখারি ৭৪১৯)

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ইমরান ইবনে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘শুধু আল্লাহই ছিলেন, তাঁর আগে আর কেউ ছিল না। আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপর এবং তিনি জিকর বা ভাগ্যফলে সবকিছু লিখে নেন এবং আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেন।’ (বুখারি ৩১৯১)

অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ আসমান ও জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে সমস্ত সৃষ্টি জগতের তাকদির লিখে রেখেছেন। আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপর।’ (মুসলিম ২৬৫৩)

আল্লাহর আরশ-

মোটকথা কোরআনের ২১টি আয়াতে আরশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে হাদিসেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরশের বিভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন। মূলতঃ আরশ হলো আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি। সেটা প্রকাণ্ড ও সর্ববৃহৎ সৃষ্টি। আরশের সামনে কুরসি একটি রিং এর মতো, যেমনিভাবে আসমান ও জমিন কুরসির সামনে রিং এর মতো। আরশের গঠন গম্বুজের মত। যা সমস্ত সৃষ্টি জগতের উপরে রয়েছে। এমনকি জান্নাতুল ফেরদাউসও আরশের নীচে অবস্থিত। আরশের কয়েকটি পা রয়েছে। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম হাশরের মাঠে তার একটি ধরে থাকবেন। এ আরশের বহনকারী কিছু ফেরেশতা রয়েছেন। তাদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআন ঘোষণা দিচ্ছেন যে, ‘কেয়ামতের দিন তারা হবেন আট।’ (সুরা আল-হাক্কাহ: আয়াত ১৭)

তবে এ ব্যাপারে ভিন্ন মত রয়েছে যে, আরশের বহনকারী ফেরেশতাগণ কি আট জন নাকি আট শ্রেণী নাকি আট কাতার। এ আয়াতে বর্ণিত পানির উপর আরশ থাকার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার আরশ কোন কিছু সৃষ্টি করার আগে পানির উপর ছিল। এর দ্বারা পানি আগে সৃষ্টি করা বুঝায় না। তবে এখানে পানি দ্বারা দুনিয়ার কোসো সমুদ্রের পানি বুঝানো হয়নি। কেননা, তা আরো অনেক পরে সৃষ্ট। বরং এখানে আল্লাহর সৃষ্ট সুনির্দিষ্ট কোন পানি উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে।

আয়াতে আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন, ‘কে কাজে শ্রেষ্ঠ’ তা তিনি পরীক্ষা করবেন। কে বেশী কাজ করেছে পরীক্ষা করবেন তা কিন্তু তিনি বলেননি। কেননা আল্লাহর দরবারে পরিমানের চেয়ে মান-সম্মত হওয়াই গ্রহণযোগ্য। আর আল্লাহর দরবারে কোনো কাজ মান-সম্মত সে সময়ই হতে পারে যখন তা আল্লাহর নির্দেশ মত এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পন্থায় হবে। নতুবা তা গ্রহণযোগ্যতাই হারাবে।

হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, তুমি ব্যয় কর, তোমার উপর ব্যয় করা হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, আল্লাহর হাত পরিপূর্ণ। কোনো প্রকার ব্যয় তাতে কোনো কিছুর ঘাটতি করে না। দিন-রাত তা প্রচুর পরিমাণে দান করে। তোমরা আমাকে জানাও, আসমান ও জমিনের সৃষ্টিলগ্ন থেকে যত কিছু ব্যয় হয়েছে সেসব কিছু তার হাতে যা আছে তাতে সামান্যও ঘাটতি করে না। আর তার আরশ হচ্ছে পানির উপর এবং তার হাতেই রয়েছে মিজান, তিনি সেটাকে উপর-নীচু করেন।’ (বুখারি ৪৬৮৪, মুসলিম ৩৭)

অন্য হাদিসে ইমরান ইবন হুসাইন বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রবেশ করলাম আর আমার উটটি দরজার কাছে বেঁধে রাখলাম। তখন তার কাছে বনু তামীম প্রবেশ করলে তিনি বললেন, বনু তামীম তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। তারা বলল, সুসংবাদ তো দিলেন, এবার আমাদেরকে কিছু দিন (সম্পদ)। এটা তারা দু’বার বললেন। তখন রাসুলের কাছে ইয়ামেনের কিছু লোক প্রবেশ করল। তিনি বললেন, হে ইয়ামেনবাসী তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর, যখন বনু তামীম সেটা গ্রহণ করল না। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা তা গ্রহণ করলাম। তারা আরও বলল, আমরা এ বিষয়ে প্রথম কি তা জানতে চাই। তিনি বললেন, আল্লাহই ছিলেন, তিনি ছাড়া আর কিছু ছিল না। আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। আর তিনি সবকিছু জিকর (লাওহে মাহফুযে) লিখে রেখেছিলেন। আর তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেন। বর্ণনাকারী ইমরান ইবন হুসাইন বলেন, তখন একজন আহবানকারী ডেকে বলল, হে ইবনুল হুসাইন! তোমার উষ্ট্রীটি চলে গেছে। তখন আমি বেরিয়ে পড়ে দেখলাম, উটটি এতদুর চলে গেছে যে, যেদিকে তাকাই শুধু মরিচিকা দেখতে পাই। আল্লাহর শপথ আমার ইচ্ছা হচ্ছিল আমি যেন সেটাকে একেবারেই ছেড়ে দেই (অর্থাৎ রাসুলের মাজলিস থেকে বের হতে তার ইচ্ছা হচ্ছিল না) (বুখারি ৩১৯১)

মানুষ বিপদে পড়লেই আল্লাহকে ডাকতে থাকে। আর বিপদ চলে গেলে তাকে ভুলে যায়। কিন্তু যারা বিপদ যাওয়ার পর ধৈর্যধারণ করে তাদের জন্য রয়েছে পুরস্কার। আল্লাহ বলেন-

اِلَّا الَّذِیۡنَ صَبَرُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ ؕ اُولٰٓئِکَ لَهُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ اَجۡرٌ کَبِیۡرٌ

‘তবে যারা সবর করেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্যই রয়েছে ক্ষমা ও মহা প্রতিদান। ‘ (সুরা হুদ : আয়াত ১১)

এ আয়াতে সত্যিকার মানুষকে সাধারণ মানবীয় দুর্বলতা হতে পৃথক করে বলা হয়েছে যে, সে সব ব্যক্তি সাধারণ মানবীয় দুর্বলতার উর্ধ্বে যাদের মধ্যে দুটি বিশেষ গুণ রয়েছে। একটি হচ্ছে ধৈর্য ও সহনশীলতা, দ্বিতীয়টি সৎকর্মশীলতা। “সবর” শব্দটি আরবী ভাষায় অনেক ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়। সবরের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বাধা দেয়া, বন্ধন করা। কোরআন ও হাদিসের পরিভাষায় অন্যায় কাজ থেকে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করাকে সবর বলে। সুতরাং শরিয়তের পরিপন্থী যাবতীয় পাপকার্য থেকে প্রবৃত্তিকে দমন করা যেমন সবরের অন্তর্ভুক্ত তদ্রুপ ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব ইত্যাদি নেক কাজের জন্য প্রবৃত্তিকে বাধ্য করাও সবরের শামিল। এর বাইরে বিপদাপদে নিজেকে সংযত রাখতে পারাও সবরের অন্তর্ভুক্ত। (ইবনুল কাইয়্যেম: মাদারেজুস সালেকীন)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার হাতে আমার আত্মা তার শপথ করে বলছি, একজন মুমিনের উপর আপতিত যে কোনো ধরনের চিন্তা, পেরেশানী, কষ্ট, ব্যথা, দুর্ভাবনা এমনকি একটি কাটা ফুটলেও এর মাধ্যমে আল্লাহ তার গুণাহের কাফফারা করে দেন। [বুখারি ৫৬৪১, ৫৬৪২; মুসলিম ২৫৭৩)

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, আল্লাহ মুমিনের জন্য যে ফয়সালাই করেছেন এটা তার জন্য ভাল হয়ে দেখা দেয়, যদি কোনো ভাল কিছু তার জুটে যায় তখন সে শুকরিয়া আদায় করে সুতরাং তা তার জন্য কল্যাণ। আর যদি খারাপ কিছু তার ভাগ্যে জুটে যায় তখন সে ধৈর্য ধারণ করে তখন তার জন্য তা কল্যাণ হিসেবে পরিগণিত হয়। একমাত্র মুমিন ছাড়া কারো এ ধরনের সৌভাগ্য হয় না।’ (মুসলিম ২৯৯৯)

হজরত নুহ আলাইহিস সালাম তাঁর কাওমের কাছে আল্লাহর দাওয়াত পৌছালে তারা তাকে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত করে। সেসব ঘটনা ও ভয়াবহ আজাব থেকে তার অনুসারিদের বাঁচাতে নৌকা তৈরির শিক্ষাদান ও এর বিবরণও পড়া হবে আজ। আল্লাহ বলেন-

وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا اِلٰی قَوۡمِهٖۤ ۫ اِنِّیۡ لَکُمۡ نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ

‘আর অবশ্যই আমি নুহ (আঃ) কে তাঁর জাতির প্রতি প্রেরণ করেছি, (তিনি বললেন) নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য প্রকাশ্য সতর্ককারী।’ (সুরা হুদ : আয়াত ২৫)

اَنۡ لَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّا اللّٰهَ ؕ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ اَلِیۡمٍ

‘তোমরা আল্লাহ ব্যতিত কারো ইবাদত করবে না। নিশ্চয় আমি তোমাদের ব্যাপারে এক যন্ত্রণাদায়ক দিনের আজাবের ভয় করছি।’ (সুরা হুদ : আয়াত ২৬)

فَقَالَ الۡمَلَاُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ قَوۡمِهٖ مَا نَرٰىکَ اِلَّا بَشَرًا مِّثۡلَنَا وَ مَا نَرٰىکَ اتَّبَعَکَ اِلَّا الَّذِیۡنَ هُمۡ اَرَاذِلُنَا بَادِیَ الرَّاۡیِ ۚ وَ مَا نَرٰی لَکُمۡ عَلَیۡنَا مِنۡ فَضۡلٍۭ بَلۡ نَظُنُّکُمۡ کٰذِبِیۡنَ

‘তখন তাঁর কওমের কাফের প্রধানরা বলল আমরা তো আপনাকে আমাদের মতো একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু মনে করি না; আর আমাদের মধ্যে যারা ইতর ও স্থুলবুদ্ধি সম্পন্ন তারা ব্যতীত কাউকে তো আপনার আনুগত্য করতে দেখি না এবং আমাদের উপর আপনাদের কোনো প্রাধান্য দেখি না, বরং আপনারা সবাই মিথ্যাবাদী বলে আমরা মনে করি।’ (সুরা হুদ : আয়াত ২৭)

হজরত নুহ আলাইহিস সালাম যখন তার জাতিকে ঈমানের দাওয়াত দিলেন, তখন জাতি তার নবুওয়াত ও রেসালাতের উপর কয়েকটি আপত্তি উত্থাপন করেছিল। নুহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর হুকুমে তাদের প্রতিটি উক্তির উপযুক্ত জবাব দান করেন। আলোচ্য আয়াতসমুহে এ ধরনের একটি কথোপকথন বর্ণিত হয়েছে।

কওমের জাহেল লোকেরা সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীকে ইতর ও ছোটলোক সাব্যস্ত করেছিল- যাদের কাছে পার্থিব ধন-সম্পদ ও বিষয় বৈভব ছিল না। মূলত তা ছিল তাদের জাহেলী চিন্তাধারার ফল। প্রকৃতপক্ষে ইজ্জত কিংবা অসম্মান ধন দৌলত বিদ্যা বুদ্ধির অধীন নয়। ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সম্পদ এবং সম্মানের মোহ একটি নেশার মত, যা অনেক সময় সত্য ন্যায়কে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, সত্য ও ন্যায় থেকে বিচ্যুত করে। দরিদ্র ও দুর্বলদের সম্মুখে যেহেতু এরূপ কোনো অন্তরায় থাকে না কাজেই তারাই সর্বাগ্রে সত্য ন্যায়কে বরণ করতে এগিয়ে আসে। প্রাচীনকাল থেকে যুগে যুগে দরিদ্র দুর্বলরাই সমসাময়িক নবীগণের উপর সর্বপ্রথম ঈমান এনেছিল।’ (কুরতুবি)

অনুরূপভাবে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস যখন ঈমানের আহ্বান সম্বলিত রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র চিঠি পেয়েছিল, তখন গুরুত্ব সহকারে নিজেই সেটার তদন্ত তাহকীক করতে মনস্থ করে। কেননা সে তাওরাত ও ইঞ্জিল কিতাব পাঠ করে সত্য নবীগণের আলামত ও লক্ষণাদি সম্পর্কে পুঙ্খানুপঙ্খরূপে পারদর্শী ছিল। কাজেই তৎকালে আরব দেশের যেসব ব্যবসায়ী সিরিয়ায় উপস্থিত ছিল, তাদের একত্রিত করে উক্ত আলামত ও লক্ষণাদি সম্পর্কে কতিপয় প্রশ্ন করে। তন্মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল যে, তার অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণী ঈমান এনেছে নাকি ধনী শ্রেণী? তারা উত্তরে বলেছিল, বরং দরিদ্র ও দূর্বল শ্রেণী। তখন হিরাক্লিয়াস মন্তব্য করল, এটা তো সত্য রাসুল হওয়ার লক্ষণ। কেননা, যুগে যুগে দরিদ্র দুর্বল শ্রেণীই প্রথমে নবীগণের আনুগত্য স্বীকার করেছে।’ (বুখারি ৭, ৫১; মুসলিম ১৭৭৩)

মূল কথা হলো, দরিদ্র ও দুর্বল লোকদেরকে ইতর এবং হেয় মনে করা চরম মূর্খতা ও অন্যায়। প্রকৃতপক্ষে ইতর ও ঘৃণিত তারাই যারা স্বীয় সৃষ্টিকর্তা পালনকর্তা মালিককে চিনে না, তার নির্দেশ মেনে চলে না। হজরত সুফিয়ান সাওরি রাহিমাহুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, ইতর ও হীন কে? তিনি উত্তর দিলেন- যারা বাদশাহ ও রাজকর্মচারীদের খোশামোদ ও তোষামোদে লিপ্ত হয়, তারাই হীন ও ইতর।

আল্লামা ইবনুল আরাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যারা দ্বীন বিক্রি করে দুনিয়া হাসিল করে তারাই হীন।

পুনরায় প্রশ্ন করা হল- সবচেয়ে হীন কে? তিনি জবাব দিলেন, যে ব্যক্তি অন্যের পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজের দ্বীন ও ঈমানকে বরবাদ করে।

ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের নিন্দা-সমালোচনা করে, সে-ই ইতর ও অর্বাচীন। (কুরতুবি)  কারণ সাহাবায়ে কেরামই সমগ্র উম্মতের সর্বাপেক্ষা হিত সাধনকারী। তাদের মাধ্যমেই ঈমানের অমূল্য দৌলত ও শরীআতের আহকাম সকলের কাছে পৌছেছে।

আল্লাহ তাআলা নুহ আলাইহিস সালামকে হতাশ না হতে বলে নৌকা তৈরির নির্দেশ দিলেন। আল্লাহর নির্দেশে তিনি নৌকা তৈরি করলেন। এ সময় মানুষ উপহাস করতে থাকে। আল্লাহ বলেন-

وَ اُوۡحِیَ اِلٰی نُوۡحٍ اَنَّهٗ لَنۡ یُّؤۡمِنَ مِنۡ قَوۡمِکَ اِلَّا مَنۡ قَدۡ اٰمَنَ فَلَا تَبۡتَئِسۡ بِمَا کَانُوۡا یَفۡعَلُوۡنَ

‘আর নুহ-এর প্রতি ওহি প্রেরণ করা হলো যে, যারা ইতিমধ্যেই ঈমান এনেছে তাদের ছাড়া আপনার জাতির অন্য কেউ ঈমান আনবেনা এতএব তাদের কার্যকলাপে বিমর্ষ হবেন না।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৩৬)

যখন নুহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় আজাব আসার জন্য বলেছিল, তখন এই কথা বলা হয়েছিল এবং নুহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন যে-

‘হে আমার প্রভু! পৃথিবীতে বসবাসকারী একজন কাফেরকেও জীবিত রেখো না।’ (তখন) আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এখন অতিরিক্ত আর কেউ ঈমান আনবে না, অতএব এ নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।’

وَ اصۡنَعِ الۡفُلۡکَ بِاَعۡیُنِنَا وَ وَحۡیِنَا وَ لَا تُخَاطِبۡنِیۡ فِی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ۚ اِنَّهُمۡ مُّغۡرَقُوۡنَ

‘আর আপনি আমার সম্মুখে আমারই নির্দেশ মোতাবেক একটি নৌকা তৈরি করুন এবং পাপিষ্ঠদের ব্যাপারে আমাকে কোনো কথা বলবেন না। অবশ্যই তারা ডুবে মরবে।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৩৭)

এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তাআলার চোখ রয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাও তাই। (মাজমু ফাতাওয়া ৫/৯০) এ আয়াত থেকে অনেক মুফাসসিরই এটা বুঝেছেন যে, নুহ আলাইহিস সালামই সর্বপ্রথম নৌকা তৈরি করেছিলেন। (আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির) কেননা পরবর্তী আয়াতে নৌকা তৈরির বিষয়টি ওঠে এসেছে।

আয়াতে তাদের শোচনীয় পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাদের সবাইকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হবে। সুতরাং আপনি আমার কাছে তাদের কারও জন্য ক্ষমা চাইবেন না। তাদের কাউকে ক্ষমা করতে বলবেন না। তারা তাদের অর্জিত কুফরির কারণে তুফানে ডুবে মরবে। (তাবারি)

এরূপ অবস্থায়ই নুহ আলাইহিস সালামের মুখে তার কাওম সম্পর্কে উচ্চারিত হয়েছিল- হে আমার রব! জমিনের কাফিরদের মধ্য থেকে কোনো গৃহবাসীকে অব্যাহতি দেবেন না, আপনি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা আপনার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে শুধু দুস্কৃতিকারী ও কাফির। (সুরা নুহ: আয়াত ২৬-২৭) এই বদদোআ আল্লাহর দরবারে কবুল হল। যার ফলে সমস্ত কওম ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

وَ یَصۡنَعُ الۡفُلۡکَ ۟ وَ کُلَّمَا مَرَّ عَلَیۡهِ مَلَاٌ مِّنۡ قَوۡمِهٖ سَخِرُوۡا مِنۡهُ ؕ قَالَ اِنۡ تَسۡخَرُوۡا مِنَّا فَاِنَّا نَسۡخَرُ مِنۡکُمۡ کَمَا تَسۡخَرُوۡنَ

– ‘তিনি নৌকা তৈরি করতে লাগলেন, আর তাঁর কওমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যখন পাশ দিয়ে যেত, তখন তাঁকে বিদ্রুপ করত। তিনি বললেন, তোমরা যদি আমাদের উপহাস করে থাক, তবে তোমরা যেমন উপহাস করছ আমরাও তদ্রুপ তোমাদের উপহাস করছি।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৩৮)

মহাপ্লাবন-

আল্লাহর আজাবে পতিত হয় নুহ আলাইহিস সালামের জাতি। যারা তাকে মেনে নিয়েছিল তারা ছাড়া তার নিজ সন্তানও আল্লাহর গজবে পতিত হয়। আল্লাহ বলেন-

حَتّٰۤی اِذَا جَآءَ اَمۡرُنَا وَ فَارَ التَّنُّوۡرُ ۙ قُلۡنَا احۡمِلۡ فِیۡهَا مِنۡ کُلٍّ زَوۡجَیۡنِ اثۡنَیۡنِ وَ اَهۡلَکَ اِلَّا مَنۡ سَبَقَ عَلَیۡهِ الۡقَوۡلُ وَ مَنۡ اٰمَنَ ؕ وَ مَاۤ اٰمَنَ مَعَهٗۤ اِلَّا قَلِیۡلٌ

‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছাল এবং ভুপৃষ্ঠ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, আমি বললাম- সর্বপ্রকার জোড়ার দুটি করে এবং যাদের উপরে আগেই হুকুম হয়ে গেছে তাদের বাদ দিয়ে, আপনার পরিজনবর্গ ও সব ঈমানদারগণকে নৌকায় তুলে নিন। বলাবাহুল্য অতি অল্পসংখ্যক লোকই তাঁর সাথে ঈমান এনেছিল।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৪০)

এ সম্পর্কে মুফাসসিরগণের বিভিন্ন উক্তি পাওয়া যায়। কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, প্লাবনের সূচনা হয় একটি বিশেষ চুলা থেকে। তার তলা থেকে পানির স্রোত বের হয়ে আসে। তারপর একদিকে আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হতে থাকে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন জায়গায় মাটি ফুড়ে পানির ফোয়ারা বেরিয়ে আসতে থাকে। এখানে কেবল চুলা থেকে পানি উথলে ওঠার কথা বলা হয়েছে এবং সামনের দিকে গিয়ে বৃষ্টির দিকে ইংগিত করা হয়েছে।

কিন্তু সুরা আল-কামার ১১-১৩ আয়াতে এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমি আকাশের দরজা খুলে দিলাম। এর ফলে অনবরত বৃষ্টি পড়তে লাগলো। মাটিতে ফাটল সৃষ্টি করলাম। ফলে চারদিকে পানির ফোয়ারা বের হতে লাগলো। আর যে কাজটি নির্ধারিত করা হয়েছিল এ দু’ধরনের পানি তা পূর্ণ করার জন্য পাওয়া গেলো।’

তাছাড়া এ আয়াতে ‘তান্নুর‘ (চুলা) শব্দটির ওপর আলিফ-লাম বসানোর মাধ্যমে একথা প্রকাশ করা হয় যে, একটি বিশেষ চুলাকে আল্লাহ এ কাজ শুরু করার জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। ইশারা পাওয়ার সাথে সাথেই চুলাটির তলা ঠিক সময়মতো ফেটে পানি উথলে ওঠে। পরে এ চুলাটিই প্লাবনের চুলা হিসেবে পরিচিত হয়।

সুরা মুমিনুনের ২৭ নং আয়াতে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে যে, এ চুলাটির কথা নুহ আলাইহিস সালামকে বলে দেয়া হয়েছিল। তবে আয়াতে বর্ণিত ‘তান্নুর’ শব্দটির অর্থ ইবন আব্বাস ও ইকরিমা এর মতে, ভূপৃষ্ঠ। [তাবারি, বাগভি, ইবনে কাসির)

পুরো জমিনটাই ঝর্ণাধারার মতো হয়ে গেল যে, তা থেকে পানি উঠতে থাকল। এমনকি যে আগুনের চুলা থেকে আগুন বের হওয়ার কথা তা থেকে আগুন না বের হয়ে পানি নির্গত হতে আরম্ভ করল। (ইবনে কাসির)

তারপর নুহ আলাইহিস সালামকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, বেঈমান কাফেরদের বাদ দিয়ে আপনার পরিজনবর্গকে এবং সমস্ত ঈমানদারগণকে কিশতিতে তুলে নিন। তবে তখন ঈমানদারদের সংখ্যা অতি নগণ্য ছিল। জাহাজে আরোহনকারীদের সঠিক সংখ্যা কোরআনে ও হাদিসে নির্দিষ্ট করে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। তাই এ ব্যাপারে কোনো সংখ্যা নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। (তাবারি)

কেউ কেউ (কিশতীতে আরোহীদের) সর্বমোট (নারী ও পুরুষ মিলে) সংখ্যা ৮০ জন এবং কেউ কেউ তার থেকেও কম বলেছেন। যাদের মধ্যে নুহ আলাইহিস সালামের তিন পুত্র সাম, হাম, ইয়াফেস ও তাঁদের স্ত্রীগণও ছিলেন, কারণ তাঁরা মুসলমান ছিলেন। এদের মধ্যে য়্যামের স্ত্রীও ছিলেন। য়্যাম ছিল কাফের; কিন্তু তার স্ত্রী মুসলমান হওয়ার কারণে তাঁকে কিশতীতে উঠানো হয়েছিল। (ইবনে কাসির)

وَ هِیَ تَجۡرِیۡ بِهِمۡ فِیۡ مَوۡجٍ کَالۡجِبَالِ ۟ وَ نَادٰی نُوۡحُۨ ابۡنَهٗ وَ کَانَ فِیۡ مَعۡزِلٍ یّٰـبُنَیَّ ارۡکَبۡ مَّعَنَا وَ لَا تَکُنۡ مَّعَ الۡکٰفِرِیۡنَ

‘আর নৌকাখানি তাদের বহন করে চলল পর্বত সমান তরঙ্গমালার মাঝে, আর নুহ (আলাইহিস সালাম) তাঁর পুত্রকে ডাক দিলেন আর সে সরে রয়েছিল, তিনি বললেন, প্রিয় বৎস! আমাদের সঙ্গে আরোহন কর এবং কাফেরদের সঙ্গে থেকো না।’ (সুরা হুদ : ৪২)

এটা নুহ আলাইহিস সালামের চতুর্থ পুত্র ছিল, যার উপাধি ছিল কিনআন এবং নাম ছিল য়্যাম। নূহ আলাইহিস সালাম তাকে এই বলে দাওয়াত দিলেন যে, তুমি মুসলমান হয়ে যাও এবং কাফেরদের সঙ্গে থেকে যারা ডুবে মরবে, তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।

قَالَ سَاٰوِیۡۤ اِلٰی جَبَلٍ یَّعۡصِمُنِیۡ مِنَ الۡمَآءِ ؕ قَالَ لَا عَاصِمَ الۡیَوۡمَ مِنۡ اَمۡرِ اللّٰهِ اِلَّا مَنۡ رَّحِمَ ۚ وَ حَالَ بَیۡنَهُمَا الۡمَوۡجُ فَکَانَ مِنَ الۡمُغۡرَقِیۡنَ

‘সে (ছেলে) বলল, আমি অচিরেই কোনো পাহাড়ে আশ্রয় নেব, যা আমাকে পানি থেকে রক্ষা করবে। নুহ (আলাইহিস সালাম) বললেন, আজকের দিনে আল্লাহর হুকুম থেকে কোনো রক্ষাকারী নেই। একমাত্র তিনি যাকে দয়া করবেন। এমন সময় উভয়ের মাঝে তরঙ্গ আড়াল হয়ে দাঁড়াল, ফলে সে নিমজ্জিত হল।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৪৩)

এ আয়াতে বলা হয়েছে যে নুহ আলাইহিস সালামের পরিবারবর্গ কিশতিতে আরোহন করল, কিন্তু একটি ছেলে বাইরে রয়ে গেল। কোনো কোনো মুফাসসির বলেন এর নাম হচ্ছে, ইয়াম (ইবন কাসির) অপর কারো মতে, কিনআন (কুরতুবি) তখন পিতৃসুলভ স্নেহবশত নুহ আলাইহিস সালাম তাকে ডেকে বললেন প্রিয় বৎস! আমাদের সঙ্গে নৌকায় আরোহন কর; কাফেরদের সঙ্গে থেকো না, তাহলে পানিতে ডুবে মরবে। কাফের ও দুশমনদের সঙ্গে উক্ত ছেলেটির যোগসাজস ছিল এবং সে নিজেও কাফের ছিল। কিন্তু নুহ আলাইহিস সালাম তার কাফের হওয়া সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে অবহিত ছিলেন না। (কুরতুবি)

পক্ষান্তরে যদি তিনি তার কুফর সম্পর্কে অবহিত থেকে থাকেন তাহলে তাঁর আহবানের মর্ম হবে নৌকায় আরোহণের পূর্বশর্ত হিসাবে কুফরি থেকে তওবা করে ঈমান আনার দাওয়াত এবং কাফেরদের সঙ্গ পরিত্যাগ করার উপদেশ দিয়েছেন। (মুয়াসসার)

কিন্তু হতভাগা প্লাবনকে অগ্রাহ্য করে বলেছিল, আপনি চিন্তিত হবেন না। আমি পর্বতশীর্ষে আরোহণ করে প্লাবন থেকে আত্মরক্ষা করব। নুহ আলাইহিস সালাম পুনরায় তাকে সতর্ক করে বললেন যে, আজকে কোনো উঁচু পর্বত বা প্রাসাদ কাউকে আল্লাহর আজাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

আল্লাহর খাস রহমত ছাড়া বাঁচার অন্য কোন উপায় নেই। দূর থেকে পিতা পুত্রের কথোপকথন চলছিল। এমন সময় সহসা এক উত্তাল তরঙ্গ এসে উভয়ের মাঝে অন্তরালের সৃষ্টি করল এবং নিমজ্জিত করল। আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে যে জমিন ও আসমান হুকুম পালন করল, প্লাবন সমাপ্ত হল, জুদী পাহাড়ে নৌকা ভিড়ল আর বলে দেয়া হল যে দুরাত্মা কাফেররা চিরকালের জন্য আল্লাহর রহমত হতে দূরীভূত হয়েছে।

পরের আয়াতে এসেছে, নবি পরিবারের অবাধ্য ব্যক্তিরা কখনো নবি পরিবারের আওতায় থাকে না মর্মেও আল্লাহ ঘোষণা দেন। আল্লাহ বলেন-

وَ نَادٰی نُوۡحٌ رَّبَّهٗ فَقَالَ رَبِّ اِنَّ ابۡنِیۡ مِنۡ اَهۡلِیۡ وَ اِنَّ وَعۡدَکَ الۡحَقُّ وَ اَنۡتَ اَحۡکَمُ الۡحٰکِمِیۡنَ

‘আর নুহ (আলাইহিস সালাম) তাঁর পালনকর্তাকে ডেকে বললেন-হে পরওয়ারদেগার, আমার পুত্র তো আমার পরিজনদের অন্তর্ভুক্ত; আর আপনার ওয়াদাও নিঃসন্দেহে সত্য আর আপনিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফয়সালাকারী।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৪৫)

قَالَ یٰنُوۡحُ اِنَّهٗ لَیۡسَ مِنۡ اَهۡلِکَ ۚ اِنَّهٗ عَمَلٌ غَیۡرُ صَالِحٍ ٭ فَلَا تَسۡـَٔلۡنِ مَا لَـیۡسَ لَکَ بِهٖ عِلۡمٌ ؕ اِنِّیۡۤ اَعِظُکَ اَنۡ تَکُوۡنَ مِنَ الۡجٰهِلِیۡنَ

‘আল্লাহ বলেন, হে নুহ! নিশ্চয় সে আপনার পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চই সে দুরাচার! সুতরাং আমার কাছে এমন দরখাস্ত করবেন না, যার খবর আপনি জানেন না। আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, আপনি অজ্ঞদের দলভুক্ত হবেন না।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৪৬)

‘নুহ (আলাইহিস সালাম) (তখন এ দোয়া পড়েছিলেন) বলেন-

رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَإِلاَّ تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُن مِّنَ الْخَاسِرِينَ

‘হে আমার পালনকর্তা! আমার যা জানা নেই এমন কোনো দরখাস্ত করা হতে আমি আপনার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৪৭)

হজরত হুদ আলাইহিস সালামের আগমন-

এরপর আল্লাহ তাআলা আদ জাতির কাছে হজরত হুদ আলাইহিস সালামকে পাঠান। তিনি তাদের মাঝে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। তারা তাকেও অস্বীকার করে। মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে। আর এসব আয়াত নাজিল করে আল্লাহ তাআলা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক দিকে সান্ত্বনা দেন। অন্য দিকে ইয়াহুদিদেরকে তাদের আগের জাতির ইতিহাস স্মরণ করিয়ে বিশ্বনবির নবুয়তের সত্যতা তুলে ধরেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ اِلٰی عَادٍ اَخَاهُمۡ هُوۡدًا ؕ قَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰهٍ غَیۡرُهٗ ؕ اِنۡ اَنۡتُمۡ اِلَّا مُفۡتَرُوۡنَ

‘আর আদ জাতির প্রতি আমি তাদের ভাই হুদকে প্রেরণ করেছি; তিনি বলেন-হে আমার জাতি, আল্লাহর বন্দেগী কর, তিনি ভিন্ন তোমাদের কোনো মাবুদ নেই, তোমরা সবাই মিথ্যা আরোপ করছ।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৫০)

وَ یٰقَوۡمِ اسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّکُمۡ ثُمَّ تُوۡبُوۡۤا اِلَیۡهِ یُرۡسِلِ السَّمَآءَ عَلَیۡکُمۡ مِّدۡرَارًا وَّ یَزِدۡکُمۡ قُوَّۃً اِلٰی قُوَّتِکُمۡ وَ لَا تَتَوَلَّوۡا مُجۡرِمِیۡنَ

‘আর হে আমার কওম! তোমাদের পালন কর্তার কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতপর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর; তিনি আসমান থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টি ধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন, তোমরা কিন্তু অপরাধীদের মত বিমুখ হয়ো না।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৫২)

وَ تِلۡکَ عَادٌ ۟ۙ جَحَدُوۡا بِاٰیٰتِ رَبِّهِمۡ وَ عَصَوۡا رُسُلَهٗ وَ اتَّبَعُوۡۤا اَمۡرَ کُلِّ جَبَّارٍ عَنِیۡدٍ

‘এ ছিল আদ জাতি, যারা তাদের পালনকর্তার আয়াতকে অমান্য করেছে, আর তদীয় রসূলগণের অবাধ্যতা করেছে এবং প্রত্যেক উদ্ধত বিরোধীদের আদেশ পালন করেছে।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৫৯)

আদ সম্প্রদায়ের কাছে একজনই নবি হজরত হুদ আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু এখানে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তারা তাঁর রাসুলদের অমান্য করল। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয় এই কথা প্রকাশ যে, একজন রাসুলকে অমান্য ও অস্বীকার করার মানে, যেন সকল রাসুলকে অমান্য ও অস্বীকার করা। কারণ সমস্ত রাসুলদের প্রতি ঈমান রাখা অপরিহার্য।

অথবা উদ্দেশ্য এই যে, এ সম্প্রদায় তাদের কুফরি ও অস্বীকার করাতে এমন অতিরঞ্জন করে ফেলেছিল যে, হুদ আলাইহিস সালামের পরেও যদি আমি তাদের মাঝে কয়েকজন রাসুল প্রেরণ করতাম, তাহলে তারা সেই সকল রাসুলদেরও অস্বীকার ও মিথ্যাজ্ঞান করত এবং তাদের কাছে কোনো মতেই এই আশা ছিল না যে, তারা কোনো একজন রাসুলের প্রতি ঈমান আনত। অথবা এও হতে পারে যে, তাদের কাছে আরও রাসুল প্রেরণ করা হয়েছিল; কিন্তু তারা সকলকে মিথ্যাজ্ঞান করেছিল।

এভাবে এ সুরায় সালেহ, লুত, ইবরাহিম, শোয়ায়েব, মুসা আলাহিস সালামসহ তাদের দ্বীনের দাওয়াত ও তাদের কাওমের অস্বীকার ও মিথ্যাচারের মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনুল কারিমে তা বিশ্বনবির নবুয়তের সত্যয়নের জন্য তুলে ধরা হয়েছে। এসব ঘটনার বর্ণনায় যাতে বিশ্বনবি প্রশান্তি লাভ করেন এবং নব মুসলিমরা অনুপ্রেরণা পায় সে উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তাআলা এ ঘটনার বর্ণনা করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘আর আমি রাসুলগণের সব বৃত্তান্তই আপনাকে বলছি, যদ্দ্বারা আপনার অন্তরকে মজবুত করছি। আর এভাবে আপনার কাছে  মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসিহত ও স্বরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে। আর যারা ঈমান আনে না, তাদেরকে বলে দাও যে, তোমরা নিজ নিজ অবস্থায় কাজ করে যাও আমরাও কাজ করে যাই। এবং তোমরাও অপেক্ষা করে থাক, আমরাও অপেক্ষায় রইলাম। আর আল্লাহর কাছেই আছে আসমান ও যমীনের গোপন তথ্য; আর সকল কাজের প্রত্যাবর্তন তাঁরই দিকে; অতএব, তাঁরই বন্দেগী কর এবং তাঁর উপর ভরসা রাখ, আর তোমাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে তোমার পালনকর্তা কিন্তু বে-খবর নন। (সুরা হুদ : আয়াত ১২০-১২৩)

সুরা ইউসুফ : আয়াত ০১-৫২

সুরা ইউসুফ অনন্য মর্যাদা সম্পন্ন একটি সুরা। আল্লাহ বিভিন্ন ঘটনাকে বিভিন্ন সুরা একাধিকবার বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে বিভিন্ন নবি-রাসুলের বর্ণনাও বিভিন্ন সুরায় করেছেন।

সুরার শুরুতেই আরবি ভাষায় নাজিল হওয়া কোরআনের সত্যতার বর্ণনা এসেছে। তার পরই হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্নের বর্ণনা করা হয়েছে। যা তিনি তার বাবাকে বলেছিলেন। বাবা তার ভাইদেরকে এ স্বপ্নের কথা বলতে নিষেধ করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা কোরআনে এ ঘটনা এভাবে তুলে ধরেন-

اِذۡ قَالَ یُوۡسُفُ لِاَبِیۡهِ یٰۤاَبَتِ اِنِّیۡ رَاَیۡتُ اَحَدَعَشَرَ کَوۡکَبًا وَّ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ رَاَیۡتُهُمۡ لِیۡ سٰجِدِیۡنَ  قَالَ یٰبُنَیَّ لَا تَقۡصُصۡ رُءۡیَاکَ عَلٰۤی اِخۡوَتِکَ فَیَکِیۡدُوۡا لَکَ کَیۡدًا ؕ اِنَّ الشَّیۡطٰنَ لِلۡاِنۡسَانِ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ

‘যখন ইউসুফ পিতাকে বললঃ পিতা, আমি স্বপ্নে দেখেছি এগারটি নক্ষত্রকে। সুর্যকে এবং চন্দ্রকে। আমি তাদেরকে আমার উদ্দেশে সেজদা করতে দেখেছি। তিনি বললেনঃ বৎস, তোমার ভাইদের সামনে এ স্বপ্ন বর্ণনা করো না। তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ৪-৫)

ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার পিতাকে বললেন, হে পিতা! আমি স্বপ্নে এগারটি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্রকে দেখেছি। আরো দেখেছি যে, তারা আমাকে সেজদা করছে। এটা ছিল ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর স্বপ্ন। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হজরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এগারোটি নক্ষত্রের অর্থ হচ্ছে ইউসুফ আলাইহিস সালামের এগারো ভাই, সূর্য ও চন্দ্রের অর্থ পিতা ও মাতা। তিনি আরও বলেন, নবীদের স্বপ্ন ছিল অহির নামান্তর।’ (তাবারি, ইবন কাসির)

হাদিসে এসেছে, ‘নেক স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন কোন খারাপ স্বপ্ন দেখবে তখন সে যেন তা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় এবং তার বাম দিকে থুথু ফেলে। ফলে সেটা তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (বুখারি ৬৯৮৬)

হে বৎস! তুমি এ স্বপ্ন ভাইদের কাছে বর্ণনা করো না। আল্লাহ না করুন, তারা এ স্বপ্ন শুনে তোমার মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত হয়ে তোমাকে বিপর্যস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে। কেননা, শয়তান হল মানুষের প্রকাশ্য শক্র। সে পার্থিব প্রভাব প্রতিপত্তি ও অর্থকড়ির লোভ দেখিয়ে মানুষকে এহেন অপকর্মে লিপ্ত করে দেয়। নবিগণের সব স্বপ্ন অহির সমপর্যায়ভুক্ত। সাধারণ মুসলিমদের স্বপ্নে নানাবিধ সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে। তাই তা কারো জন্য প্রমাণ হয় না।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন সময় ঘনিয়ে আসবে (কেয়ামত কাছাকাছি হবে) তখন মুমিন ব্যক্তির স্বপ্ন প্রায়ই সত্য হবে। আর মুমিনের স্বপ্ন নবুয়তের চল্লিশতম অংশ, আর যা নবুওয়াতের এ অংশের স্বপ্ন, তা মিথ্যা হবে না। বলা হয়ে থাকে, স্বপ্ন তিন প্রকার। এক প্রকার হচ্ছে মনের ভাষ্য, আরেক প্রকার হচ্ছে শয়তানের পক্ষ থেকে ভীতি জাগ্রত করে দেওয়া। আর তৃতীয় প্রকার স্বপ্ন হচ্ছে- আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অপছন্দনীয় কিছু দেখে তবে সে যেন তা কারো কাছে বিবৃত না করে; বরং উঠে এবং নামাজ আদায় করে।’ (বুখারি ৭০১৭)

এ সুরায় আল্লাহ তাআলা শুধুমাত্র হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যা অন্য কোনো সুরায় বর্ণনা হয়নি। সুরা ইউসুফের প্রতিটি আয়াতই সুন্দর ঘটনায় সাজানো। এ ঘটনা জানতে তাই পুরো সুরাটাই পড়ার বিকল্প নেই। যাতে রয়েছে অনেক শিক্ষা ও নসিহত।

হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের জীবনের ঘটনার সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের সঙ্গে মিল রয়েছে। আল্লাহ তাআলা হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ন্যায় বিশ্বনবিকে নবুয়তের প্রারম্ভে সত্য স্বপ্ন দেখান।

তাছাড়া হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের আপন-জন তাঁকে অনেক কষ্ট ও নির্যাতন করেছেন উপরন্তু তিনি তার ভাইদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করেছেন। তাদের প্রতি কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কোনো অত্যাচার নির্যাতনই হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে অধৈর্য করে তোলেননি।

ঠিক বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নবুয়তের শুরু থেকেই কাছে আত্মীয়-স্বজন দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন। অধৈর্য হননি এবং কারো প্রতি প্রতিশোধও গ্রহণ করেননি। এমনকি জুলুম অত্যাচারের কারণে বিশ্বনবিকে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে হয়েছে।

বারবার মদিনা আক্রমণ করে ইসলাম ও বিশ্বনবিকে চিরতরে শেষ করে দিতে চেয়েছে। অতপর বিশ্বনবি যখন অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয় করলেন, তখন তিনি বললেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি পরম দয়ালু।

সর্বোপরি আল্লাহ তাআলা সুরা ইউসুফ নাজিল করেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যই নাজিল করেছেন। এজন্য সুরা ইউসুফ অনন্য মর্যাদার অধিকারী।

আল্লাহ তআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন বুঝে পড়ার এবং তাঁর ওপর আমল করার পাশাপাশি নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএইচডি/ আই. কে. জে /

আরো পড়ুন:

রমজানে কোরআন পাঠে অধিক সওয়াব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *