নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: ১০০ বছর ধরে দেশের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার পর, সার্বিক উন্নয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢেলে সাজানোর মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ১৯২১ সাল থেকে উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ স্থান হিসেবেই পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিন ধাপে ১০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের সময় নির্ধারণ হয়েছে ১৫ বছর। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে বৃহৎ পরিসরের এ উদ্যোগের পরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে।
অনুমোদন পেলেই প্রশাসন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের প্রথম সৌরশক্তি সম্পন্ন ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করবে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং নামে পরিচিত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পদ্ধতি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনকে আরও সবুজ করে তোলার কাজ করা হবে।
পাশাপাশি নতুন অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন নির্মান, নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা খেলার মাঠ, সংরক্ষিত সাইকেল লেন তৈরিসহ আরও নানা সংস্কারের কাজ করা হবে।
এ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম ধাপের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা বাজেট ধরা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনকে আরও পরিবেশবান্ধব করে তোলা ও পড়াশোনার পরিবেশের মানোন্নয়ন করাই এ প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে এ পরিকল্পনা পাস হয়।
প্রতিষ্ঠানটি এক শতাব্দী আগে ১২টি বিভাগ, তিনটি আবাসিক হল, ৬০ জন শিক্ষক ও ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন ও সকল ক্ষেত্রে গবেষণা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে।
গত শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এপর্যন্ত দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বিভাগ ও ইনস্টিটিউশন এবং আবাসিক হলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেওয়া এ উদ্যোগ এখন পর্যন্ত সর্ববৃহৎ, প্রতিষ্ঠানটির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতেও এ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) এবং মাস্টার প্ল্যান টেকনিক্যাল কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, “বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী আধুনিকৃত উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ পরিকল্পনা পাস করেছে সিন্ডিকেট,”
“ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভা বর্ধন ও শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য এ মাস্টারপ্ল্যান হাতে নেওয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হবে এমনটাই আশা করছি।” বলেন তিনি।
“শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীরা বর্তমানে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হলে আমরা বিদ্যমান এসব সমস্যার সমাধান করতে পারবো। আধুনিক কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গবেষণার অনুকূল পরিবেশ তৈরির পরিকল্পনাও করছি আমরা।” যোগ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী বলেন, “মাস্টারপ্ল্যানটি অসাধারণ এমনটাই শুনেছি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি আরও বৃদ্ধি পাবে,”
“বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য গবেষণা। তবে একই সাথে অবকাঠামো ও শিক্ষার অনুকূল পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের পর গবেষণার মানোন্নয়ন হবে বলেই বিশ্বাস করি। ” বলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জানান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল সংকট, দুর্বল গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশকে বিঘ্নিত করে।
“এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই, পরিকল্পনা শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এব্যাপারে আমি আশাবাদী।” বলেন তিনি।
আধুনিকৃত কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। এ গ্রন্থাগারে ৩ লাখের বেশি বই ও ৪০ হাজারের বেশি জার্নাল আছে। ঐতিহাসিক বই ও নথির দুর্লভ সংগ্রহও আছে গ্রন্থাগারটিতে।
তবে আসন সীমাবদ্ধতার কারণে সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষক গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে পারেন না। একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মাত্র ২ শতাংশ গ্রন্থাগারে পড়তে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ও ২ হাজার শিক্ষক আছেন। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন ১০ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
আবাসিক হলের নির্মাণকাজ ও সংস্কার
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩টি আবাসিক হলে মাত্র ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর। নতুন মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন হলে ৮০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী আবাসিক হলে থাকার জায়গা পাবেন।
বিদ্যমান সব হলেরই সংস্কার করা হবে এবং পরিকল্পনার ধাপে ধাপে নতুন হল নির্মাণ করা হবে। এছাড়াও শাহ নেওয়াজ হল সংস্কারের পর নাম পাল্টিয়ে জয় বাংলা হল রাখা হবে।
দেশের প্রথম সৌরশক্তি সম্পন্ন ক্যাম্পাস
নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে দেশের প্রথম সৌর শক্তিসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গ্রিড বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে শতভাগ সৌর শক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে বিশ্ববিদ্যালয়।
রোকেয়া হলের পাশে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা খেলার মাঠ নির্মাণ করা হবে, জিমনেসিয়াম ও সুইমিংপুল মতো সব সুবিধাই থাকবে। এছাড়াও, যানজট কমিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও পরিবেশবান্ধব করতে সাইকেল আরোহীদের জন্য আলাদা সাইকেল লেন তৈরি করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভবনে রেনওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে। ভূগর্ভের পানি ব্যবহার কমানো বাধ্যতামূলক করা হবে।
আধুনিক রেজিস্ট্রার বিল্ডিং ও মেডিক্যাল সেন্টার
রেজিস্ট্রার বিল্ডিং তৈরির সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১০ হাজার শিক্ষার্থী থাকায় বর্তমানে গুরুতর স্থান সংকটের মুখে পড়েছে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং। বর্তমানে অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীসহ প্রায় সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষার্থীদের পরিষেবা দিয়ে থাকে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং। এ পরিস্থিতির কারণে কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের দ্রুত সেবা দিতে পারেন না, অনেক সময় একদিনের কাজ শেষ হতেই এক মাস সময় লেগে যায়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে শিক্ষার্থীরা শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা পেয়ে থাকে।গুরুতর চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা অন্যান্য হাসপাতালে যেতে হয়।
নতুন পরিকল্পনার অধীনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশেষায়িত চিকিৎসক নিয়োগের মাধ্যমে মেডিক্যাল সেন্টারকে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ মেডিক্যাল সেন্টার হিসেবে গড়ে তুলবে।
বহুতল ডাকসু ভবন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ব্রিটিশ আমল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে বর্তমানে ডাকসু ভবনের বড় পরিসরে সংস্কার প্রয়োজন। ভবনটিতে একটি জাদুঘরও আছে, তবে যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও জায়গার স্বল্পতার কারণে জাদুঘরের প্রদর্শনীর অনেক নিদর্শনই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নতুন মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় পুরাতন ভবন ভেঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে।