তাপস হালদার:
১৫ অক্টোবর ১৯৮৫ সাল। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। রাত সাড়ে আটটায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) চলছিল মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘শুকতারা’। নাটকটিতে জগন্নাথ হলের ছাত্র মৃন্ময় অধিকারীও অভিনয় করেছিলেন। তখন তো বিনোদনের একমাত্র মাধ্যমই ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। সেদিন বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ জনিত কারণে দমকা হাওয়াসহ প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যেও প্রায় চারশ দর্শকে হল রুম ভর্তি হয়ে যায়। রাত পৌনে ৯টার দিকে জরাজীর্ণ ভবনটি হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে। যারা ভিতরে জায়গা না পেয়ে বাইরে থেকে দরজা জালনার পাশ দিয়ে নাটক দেখছিল তারাই শুধু বের হতে পেরেছিল অক্ষত অবস্থায়, তাছাড়া অধিকাংশ লোকই চাপা পড়ে যায়। বৈদ্যুতিক সংযোগ বিছিন্ন ও বৃষ্টির কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হয়। আহত ছাত্রদের আর্তচিৎকারে জগন্নাথ হলের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেদিন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ হতাহতদের পাশে দাঁড়িয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিল।
আরও পড়ুন: শুভ জন্মদিন বিশ্ব মানবতার মা শেখ হাসিনা
মাইকে যখন আহতদের চিকিৎসার জন্য রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয় তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছাত্র, পথচারী থেকে রিক্সাচালক শত শত ভিন্ন ধর্মাবলম্বী অপরিচিত লোক রক্ত দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিল, আহতদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল।এমন অসাম্প্রদায়িক মানবতার উদাহরণ খুব একটা নেই। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৩৪ জন, পরে হাসপাতালে আরো ৬ জন। মোট ৪০টি তাজা মেধাবী প্রাণ চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। যার মধ্যে ছিল ২৬ ছাত্র, ১৪ জন কর্মচারী ও অতিথি। আহত হয় তিন শতাধিকেরও বেশি।
জগন্নাথ হলের আজকের ‘অক্টোবর ভবন’ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পারিষদ ভবন, আজ যা সংসদ ভবন । ১৯৪৭ সাল থেকে এখানেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসত। একে অ্যাসেম্বলি ভবনও বলা হত। ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এই ভবনেই বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের চেয়ার নিক্ষেপে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান সরকারের ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী নিহত হন। ১৯৬৩ সালে নতুন প্রাদেশিক ভবন নির্মাণ হলে ভবনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করা হয়। ভবনটি ছিল দেড়শ বছরের পুরনো। ব্রিটিশ শাসনামলে চুন, সুরকি, লোহার রডের বিম দিয়ে তৈরি ভবনটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ছাত্ররা এখানে বসবাস করতো না। স্বাধীনতার পর ভবনটি শহীদ আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের নামে নামকরণ করা হয়। ১৯৭৯ সালে ছাত্রদের বিনোদনের জন্য অনুদ্বৈপায়ন ভবনে কর্তৃপক্ষ একটি রঙ্গিন টেলিভিশনের ব্যবস্থা করেছিল।
সেদিনের ভয়াবহ ঘটনায় সরকার তিনদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করে। ১৬ অক্টোবর সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। খবরের কাগজের প্রতিটি পাতাই ভরে গিয়েছিল আহত নিহতদের ছবি দিয়ে, রেড়িওর মাধ্যমে গোটা বিশ্বে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে সারাক্ষণই প্রচার করা হয়েছিল হৃদয় বিদারক দৃশ্যের চিত্রগুলো। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোকের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে জনপ্রিয় নাটকটি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। সে বছর থেকেই ১৫ অক্টোবর দিনটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
দুর্ঘটনার কয়েকদিন পর ১৯ অক্টোবর হিন্দু ধর্মাম্বলীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হলেও জগন্নাথ হলের শোকাবহ ঘটনার কারণে সারা দেশে অনাড়ম্বরভাবে পূজা করা হয়। ব্যানারে লেখা হয়েছিল ‘কাঁদো দেশবাসী কাঁদো’।
প্রতিবছর নিহতদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে ১৫ অক্টোবর প্রতিটি হল, প্রধান প্রধান ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন, বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সকালে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শোক পদযাত্রা করে জগন্নাথ হলে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও নিরবতা পালন করে থাকেন। জগন্নাথ হলে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ছাত্ররা স্ব স্ব ধর্মমতে প্রার্থনা সভা, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদসহ সকল মসজিদে বিশেষ মোনাজাত করা হয়ে থাকে। দিনব্যাপী জগন্নাথ হলে নিহতদের তৈলচিত্র ও বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন প্রদর্শন, রক্তদান কর্মসূচী, উপাসনালয়ে ভক্তিমূলক গান গেয়ে শহীদদের স্মরণ করা হয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে তিনটি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল তার মধ্যে একটি জগন্নাথ হল। ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জগন্নাথ হলের রয়েছে গৌরবোজ্জল ভূমিকা । ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে প্রথমেই হামলা চালায় জগন্নাথ হলে। নির্বিচারে হত্যা করে হলের ছাত্র, শিক্ষক কর্মচারীদেরকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ইতিহাসের সাথে মিশে আছে জগন্নাথ হলের নাম। জগন্নাথ হলকে বাদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লেখা যাবে না।
১৫ অক্টোবরের বিয়োগান্ত ঘটনাকে স্মরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার পালন করে শোক দিবস । আজকের দিনে সেদিনের সকল শহীদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
ইমেইল: haldertapas80@gmail.com