ডেস্ক রিপোর্ট, ধূমকেতু বাংলা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সে পড়েন ওমর কাইয়্যুম। করোনার কারণে বাড়িতেই কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা প্রায় শেষ দিকে। এখন নিচ্ছেন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি। তবে দীর্ঘদিন পর হলে ফিরে পড়ার পরিবেশ না পেয়ে প্রতিদিন ভোরে উঠে লাইব্রেরিতে যান। লাইব্রেরির গেটের সামনে ব্যাগের সারিতে নিজের ব্যাগটি রাখতে হয় কাইয়্যুমকে। ভেতরে বসার জন্য পছন্দমতো একটি সিট পেতে অপেক্ষা করেন গেটের সামনে।

শুধু কাইয়্যুম নন, এমন অনেককেই দেখা যায় লাইব্রেরিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে সিট সংকটের কারণে এ চিত্র নিত্যদিনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে ১৮টি হলে সব মিলিয়ে ১৭ হাজার ৬০ জনের আবাসন সুবিধা রয়েছে। এটি মোট শিক্ষার্থীর ৪৬ শতাংশ। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আরেক তথ্য অনুযায়ী, মোট শিক্ষার্থীর ৬০ ভাগই আবাসিক হলে থাকেন। ফলে হলে পড়ার জন্য পর্যাপ্ত রিডিং রুম বা থাকার পরিবেশ কোনোটাই থাকে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হয়েছেন রাব্বি হাসান। ২৫ জনের রুমে কোনোমতে মাথাটা গুঁজে থাকেন। যে স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন তা হলে ওঠার শুরুর দিনই যেন এক প্রলয়ঙ্করি ঝড়ে ধ্বংস হয়েছে। গণরুমের নতুন তত্ত্বই যেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার প্রথম পাঠ।

‘স্বপ্নে’র বিশ্ববিদ্যালয় কেমন ছিল জানতে চাইতেই রাব্বি হাসান বলেন, ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কিছু জানবো, শিখবো। পড়ালেখার চমৎকার একটা পরিবেশ থাকবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার সুন্দর একটি পরিবেশ থেকে জ্ঞান অর্জন করবো। অথচ বাস্তবতা পুরোপুরি বিপরীত।

আবাসন, গ্রন্থাগারে সিট, শ্রেণিকক্ষ, বিশ্বমানের গবেষণাগার সংকটসহ নানা সমস্যা নিয়ে শতবর্ষে দাঁড়িয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শতবর্ষে এসে সংকট কাটাতে নতুন এক মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মহাপরিকল্পনায় গবেষণা ও শিক্ষার গুণগত মানের পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার নতুন যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় তা এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনুমোদনের অপেক্ষায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে গত বছর এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে তিনটি ধাপে মোট ১৫ বছরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। যেখানে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তিন ধাপে মোট ৯৭টি ভবন নির্মাণের প্রস্তাব আনা হয়েছে। এতে নতুন একাডেমিক ভবনের সংখ্যা ১৭টি। আবাসনের ক্ষেত্রে ছাত্রীদের জন্য ৮টি, ছাত্রদের ১৬টি, হাউজ টিউটরদের ২২টি, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ১২টি ও কর্মচারীদের জন্য ৯টি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে আরও ১৩টি ভবন নির্মাণের প্রস্তাব।

এর মধ্যে প্রথম ধাপে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপেই শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য ১২ তলাবিশিষ্ট একটি সুউচ্চ ভবন নির্মাণের প্রস্তাব আনা হয়েছে, যাতে রক্ষা করা হবে গ্রন্থাগার সেবার মান এবং বিদ্যমান কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ঐতিহ্য। এছাড়া প্রস্তাবনায় রয়েছে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ১০ তলাবিশিষ্ট এমবিএ টাওয়ার, আইএসআরটি ও ফার্মেসি বিভাগের জায়গায় একটি ১০ তলা ভবন, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের জন্য তিনতলা ভবন, চারুকলায় একটি পাঁচতলা ভবন এবং নীলক্ষেতের প্রেস ভবন ও পুলিশ ফাঁড়ি ভেঙে ১১ তলা একাডেমিক ভবন ও পাঁচতলা প্রেস ভবন।

শিক্ষার্থীদের আবাসিক অবকাঠামো উন্নয়নের প্রথম ধাপে রয়েছে নিউমার্কেট এলাকায় শাহনেওয়াজ হোস্টেল ভেঙে ১৫তলা জয় বাংলা হল ও ১১ তলাবিশিষ্ট হাউজ টিউটর ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা।

একইভাবে শামসুন্নাহার হলে তিনটি সুউচ্চ ভবন, শহীদ অ্যাথলেট সুলতানা কামাল হোস্টেলের এক্সটেনশন হিসেবে তিনটি ভবন ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে দুটি ভবন নির্মাণের প্রস্তাবনাও রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ ফুলার রোডে শিক্ষকদের জন্য ১৫ তলাবিশিষ্ট রেসিডেন্সিয়াল টাওয়ার। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে তিনটি ভবন, সূর্যসেন হলের ১১ তলাবিশিষ্ট দুটি ভবন ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে তিনটি ভবন নির্মাণ। সূর্যসেন হল ও মুহসীন হলের প্রভোস্ট বাংলো ভেঙে দোতলাবিশিষ্ট প্রোভিসি বাংলো নির্মাণ।

দেশের ইতিহাসের সাক্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনটিও বেশ পুরোনো। ফলে মহাপরিকল্পনার অধীনে বিদ্যমান ভবন ভেঙে নতুন করে ত্রিকোণাকৃতির প্রশাসনিক ভবন নির্মিত হবে বর্তমান প্রশাসনিক ভবনটির স্থানে। ত্রিকোণাকৃতির এ ভবনের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকবে উপাচার্যের কার্যালয়, দু’পাশে দুই উপ-উপাচার্যের কার্যালয় এবং এক পাশে থাকবে কোষাধ্যক্ষের দপ্তর। আর ভবনের সামনে থাকবে একটি ফোয়ারা। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) দোতলা ভবন ভেঙে বহুতল ভবন তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে ডাকসু নেতাদের জন্য কক্ষসহ থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরও।

মহাপরিকল্পনার আওতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরের অবকাঠামোগুলোতেও রয়েছে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব। রাজধানীর গ্রিন রোডে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৬ দশমিক ১ একর জায়গার একটি অংশে বিপণি-বিতান ও অন্য অংশে আইবিএ হোস্টেল রয়েছে। নতুন পরিকল্পনায় স্থানটিতে বহুতল ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে, যেখানে থাকবে আইবিএ হোস্টেলসহ একটি আধুনিক বিপণি-বিতান ও একটি কনভেনশন হল, যা ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে।

এছাড়া পরিবহন ব্যবস্থায়ও আনা হচ্ছে নতুন পরিকল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের জন্য কার্জন হল থেকে কলাভবন পর্যন্ত আলাদা সাইকেল লেন স্থাপন করা হবে। রয়েছে বহিরাগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণেও বেশকিছু নির্দেশনা।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রস্তাবিত সময়সীমার চেয়ে মহাপরিকল্পনাটি সমন্বিতভাবে গুণগত মান বজায় রেখে দ্রুত বাস্তবায়ন চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে মহাপরিকল্পনাটি দ্রুতই ঢেলে সাজিয়ে নতুন এক রূপ নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্বমানের গ্রন্থাগার সুবিধা, গাড়ি পার্কিং, যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ, সবুজায়ন, খেলার মাঠ উন্নয়ন, সোলার এনার্জি স্থাপন, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংসহ জলাধার, সৌন্দর্যবর্ধন, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, আধুনিক জিমনেশিয়াম ও আধুনিক মেডিকেল সেন্টার স্থাপন করাও মহাপরিকল্পনায় রয়েছে।

এছাড়া নতুন সুউচ্চ আধুনিক ভবনের পাশাপাশি সংস্কার করা হবে পুরোনো ভবনও। মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হলে আমূল পরিবর্তন দেখা যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনাজুড়ে।

মহা এ কর্মযজ্ঞ ও সেটি চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, মহাপরিকল্পনাটি একটি ভালো অনুকূল শিক্ষার পরিবেশ এবং আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো, গবেষণা, শিক্ষা পরিবেশের জন্য শক্তিশালী অনুষঙ্গ। শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম আবর্তন করেই আমাদের মাস্টারপ্ল্যানটি প্রণীত। ফলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে একটি অনুকূল বা আধুনিক পরিবেশ প্রাপ্তির লক্ষ্যে এটি কাজ করবে। অন্যদিকে এর একটি প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের জীবনমানেও। এতে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটবে। যার মধ্য দিয়ে তাদের গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়বে।

উপাচার্য বলেন, মাস্টারপ্ল্যানটির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব প্রথম প্রধানমন্ত্রীই অনুধাবন করেছেন। কেননা আমাদের দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিক উন্নয়ন হয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতেন যে, যে কোনো ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পরিকল্পনা, শিক্ষা, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা এগুলোর সম্প্রসারণে যেন একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকে। মহাপরিকল্পনাটি এটির বহিঃপ্রকাশ। তাই গুণগত ও বৈশ্বিক মান বজায় রেখে মহাপরিকল্পনাটি কত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়টি ভাবতে বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। সবাইকে একটি সমন্বিত নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

আরো পড়ুন:

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আগতদের কোভিড সনদ বাধ্যতামূলক

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *