স্বাস্থ্য

ঢাকায় করোনা আক্রান্ত ৮২ শতাংশের কোনো উপসর্গ নেই | সংক্রমণ হয়ে গেছে প্রায় কোটি মানুষের

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষের করোনা সংক্রমণ ঘটে গেছে। অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ফলাফল বলছে, তিন মাস আগেই রাজধানীর ৪৫ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনা-ভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা অনুমান করছেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছিল।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) যৌথ গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসের সংক্রমণ হলে তা প্রতিহত করার জন্য রক্তের শ্বেতকণিকা অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এর মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা জন্ম নেয়। অ্যান্টিবডি শনাক্তের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সংক্রমিত হয়েছিলেন কি না, তা জানা যায়।

গবেষকেরা শ্বাসতন্ত্রের তরল পদার্থ (আরটি-পিসিআর) এবং রক্তের নমুনা পরীক্ষার (অ্যান্টিবডি) মাধ্যমে সংক্রমণ পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, নারী-পুরুষের মধ্যে সংক্রমণ প্রায় সমান। ঢাকা শহরের বস্তির প্রায় তিন–চতুর্থাংশ মানুষ ইতিমধ্যে সংক্রমিত হয়েছেন।

সোমবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে এ গবেষণা ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে কোভিড-১৯–এর প্রকোপ, অ্যান্টিবডি পর্যবেক্ষণ এবং করোনাভাইরাসের জিনগত রোগতত্ত্বের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। গবেষকেরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসা ও টিকা দেওয়ার ব্যাপারে এ তথ্য কাজে লাগবে।

সংক্রমণ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মার্চ মাস থেকে যে তথ্য দিয়ে আসছে, তা নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ ছিল। তাদের ধারণা, সরকার যে সংক্রমণের তথ্য প্রচার করছে, বাস্তবে আক্রান্তের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। ১২ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ঢাকা শহরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল দুই লাখের কম। আর গবেষণা বলছে, এই সংখ্যা প্রায় এক কোটি।

গবেষণার তথ্য এমন সময় প্রকাশ করা হলো, যখন দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আলোচনা চলছে। আসন্ন শীত মৌসুমে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকির কথা বলছে সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি তাদের আছে।

অনলাইনে অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিশ্বের কোনো দেশেরই জানা ছিল না। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসায় বাংলাদেশ উন্নত দেশের তুলনায় ভালো করেছে। তিনি বলেন, গবেষণার তথ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উপকৃত হয়েছে।

সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, দেশ কি হার্ড ইমিউনিটির (গণরোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠা) পথে? আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরি বলেন, হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠার কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। সংক্রমিত ব্যক্তিদের শরীরে কত দিন অ্যান্টিবডি থাকবে, তা–ও নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।

গবেষণা পদ্ধতি

গবেষণার জন্য ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্য থেকে দৈবচয়ন ভিত্তিতে ২৫টি ওয়ার্ড বেছে নেওয়া হয়। প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে একটি মহল্লা বাছাই করা হয়। প্রতিটি মহল্লা থেকে ১২০টি খানা জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ৮টি বস্তিকে এ জরিপে যুক্ত করা হয়। মোট ৩ হাজার ২২৭টি খানার সদস্যদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

রাজধানীর কোটি মানুষ সংক্রমিত

অনুষ্ঠানে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরি। তাতে দেখা যায়, ঢাকা শহরের ৪৫ শতাংশ মানুষ ইতিমধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আর বস্তির মানুষের মধ্যে এ হার ছিল ৭৪ শতাংশ।

গবেষণা–সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা শহরের সংক্রমণের এ তথ্য জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ের। সংক্রমণের ধারা অনুসরণ করলে অনুমান করা যায়, গত তিন মাসে আক্রান্তের হার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশে পৌঁছেছে।

ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে ধারণা করা হয়, জনসংখ্যা দুই কোটি বা তার বেশি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গবেষকেরা মনে করেন, ইতিমধ্যে শহরের প্রায় এক কোটি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন।

উপসর্গযুক্ত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষায় ১০০ শতাংশে অ্যান্টিবডি পেয়েছেন গবেষকেরা। অন্যদিকে উপসর্গহীন ৪৫ শতাংশের রক্তে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। এর অর্থ হচ্ছে ঢাকা শহরের বহু মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের কোনো উপসর্গ নেই। তারা দিব্যি রাস্তাঘাটে, বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অফিস করছেন।

গবেষকেরা বলেছেন, অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার অর্থ এই নয় যে একজন ব্যক্তি এ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিমুক্ত।

এক প্রশ্নের উত্তরে ফেরদৌসী কাদরি বলেন, দু-একজনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে তা–ও এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। একই প্রশ্নের উত্তরে আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এইচ এম আলমগীর বলেন, বিশ্বে এ পর্যন্ত ২৭ জনের দ্বিতীয়বার সংক্রমণ ঘটেছে, এমন নজির পাওয়া গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *