বড় কাটরা, ঢাকা মুগল রাজধানী ঢাকার চক বাজারের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে অবস্থিত। মধ্য এশিয়ার ক্যারাভান সরাই-এর ঐতিহ্য অনুসরণে নির্মিত বড় কাটরা দারুণভাবে সুরক্ষিত এবং মুগল রাজকীয় স্থাপত্য-রীতির সকল বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি বিদ্যমান।

বড় কাটরা নির্মাণ করেন কে?*

সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে (হিজরী ১০৫৫) বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়। এর নির্মাণ করেন আবুল কাসেম যিনি মীর-ই-ইমারত নামে পরিচিত ছিলেন। প্রথমে এতে শাহ সুজার বসবাস করার কথা থাকলেও পরে এটি মুসাফিরখানা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

আয়তাকারে নির্মিত এ অট্টালিকার দক্ষিণ বাহু ছিল ৬৭.৯৭ মিটার দীর্ঘ। উত্তর বাহুও একই মাপের ছিল বলে ধারণা করা হয়। পূর্ব-পশ্চিম বাহুর দৈর্ঘ্য এখন নিরূপণ করা দুঃসাধ্য হলেও আদিতে ৭০.১০ মিটার করে ছিল বলে জানা যায়।

তিনতলা বিশিষ্ট এ সদর তোরণ ছিল অতি মনোমুগ্ধকর এবং এটি দক্ষিণে নদীর দিকে প্রায় ৭.৬১ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১২.১৯ মিটার প্রসারিত ছিল। এ প্রবেশপথের দুপাশে ছিল দুটি প্রহরীকক্ষ। প্রহরীকক্ষ দুটির আয়তন ছিল পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ৫.৫১ × ২.৯২ মিটার।

এ প্রবেশপথের পরে ছিল পরপর তিনটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আয়তনের প্রবেশপথ। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা প্রবেশপথের আয়তন ছিল যথাক্রমে ২.৭৪ × ০.৯১ মি. , ৩.৩৫ × ১.৮২ মি, এবং ২.৭৪ × ১.৮২ মি. ।

উপরে বর্ণিত চারটি প্রবেশ পথের পরেই ছিল অষ্টকোণাকৃতির একটি হল কামরা এবং এর উপরের ছাদ ছিল গম্বুজাকৃতির এবং তাতে পলেস্তরার উপর নানা রকম লতাপাতা ইত্যাদির সুন্দর অলঙ্করণ ছিল। এ হল কামরার মাঝামাঝি অংশের সোজা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ছিল পর পর দুটি করে কামরা।

কাটরার ভেতর দিকে দোতলা ও তিনতলায় ওঠার সিঁড়ি আছে। দক্ষিণ দিকের প্রসারিত অংশ ছাড়া কাটরার এ অংশের আয়তন প্রায় ১৮.২৮ × ১৩.৪১ মিটার। উপরে দোতলায় এবং তিনতলায় নির্মিত ছিল বসবাসের কক্ষ। শুধু প্রবেশপথের উপরের অংশই ছিল তিনতলা বিশিষ্ট।

তিনতলার কক্ষসমূহ চতুষ্কোণাকার এবং অশ্বক্ষুরাকৃতি ফ্লা্যট আর্চ সম্বলিত ছিল। কাটরার বাকি অংশ ছিল দ্বিতল।

প্রবেশপথ এলাকায় দুপাশে নিচতলায় প্রত্যেক ভাগে ৫টি করে ভল্টেড কক্ষ রয়েছে যেগুলিতে বর্তমানে সাদা পলেস্তরা করা হয়েছে। প্রত্যেক দিকের শেষ দুটি কক্ষ থেকে উত্তরভাগে কিছু অংশ কেটে নিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ১টি করে আলাদা কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। এ কক্ষসমূহ ভল্টযুক্ত নয় এবং এগুলির সামনে আছে টানা বারান্দা।

দক্ষিণ ব্লকের দুকোণে দুটি বিরাট টাওয়ার রয়েছে। অষ্টকোণাকৃতির টাওয়ারসমূহ ফাঁকা প্যানেল অলংকরণ সম্বলিত এবং ব্যাস ৩.০৪ বর্গ মিটার। কোণার কক্ষসমূহ থেকে এ টাওয়ার দুটিতে যাওয়া যায়।

বড় কাটরায় ফারসি ছন্দোবদ্ধ পংক্তিযুক্ত দুটি শিলালিপি আছে। এর একটিতে উৎকীর্ণ আছে যে, ইমারতটি ১০৫৩ হিজরিতে (১৬৪৩-৪৪ খ্রি) নির্মিত এবং অন্যটিতে আছে ১০৫৫ হিজরিতে (১৬৪৫-৪৬ খ্রি) নির্মিত। উল্লেখ আছে যে, শাহ সুজা এ ভবনটি মীর আবুল কাশিমকে কাটরা (দফতর) হিসেবে ব্যবহারের দায়িত্ব দেন এ শর্তে যে, এ ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীগণ কাটরায় অবস্থান করার প্রকৃত ও যোগ্য কোন ব্যক্তির নিকট থেকে কোন ভাড়া গ্রহণ করবেন না।

বড় কাটরা ইতোমধ্যে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সামগ্রিকভাবে ইমারতটি ধ্বংসের মুখে উপনীত হয়েছে। বিভিন্ন কারণে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক ভবনটি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় নি। ভবনে অবস্থানকারীদের অনেকেই বহুবার আদি ভবনের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ধ্বংস হওয়া সত্ত্বেও বড় কাটরা ইমারতটি বাংলায় মুগল স্থাপত্যের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *