স্বাস্থ্য

ডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে করণীয় || যা বলছেন চিকিৎসকরা

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: নীরব ঘাতক ডায়াবেটিসে আশঙ্কাজনক আক্রান্ত ও মৃতের হার হ্রাসে সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তারা বলছেন, যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে, তারা প্রথমদিকে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন না। এই সংখ্যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৫০ শতাংশ। এটি আস্তে আস্তে মানুষের শরীর ক্ষয় করে দেয়। ডায়াবেটিস নিজে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ।

ডায়াবেটিসের জটিলতায় সংঘটিত হৃদরোগ, কিডনি রোগ, চোখের রোগ, স্নায়ু রোগ, গর্ভকালীনসহ নানা  দীর্ঘস্থায়ী জটিলতার শিকার হয়ে অকালে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে। সতর্ক থাকলে ডায়াবেটিসের ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু একবার ডায়াবেটিস হয়ে গেলে আর এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লাখ।

এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত সাত সপ্তাহের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনা বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, করোনা শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৩ শতাংশ। অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের তুলনায় ডায়াবেটিস রোগীরাই সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। এরপর পর্যায়ক্রমে উচ্চ রক্তচাপ, বক্ষব্যাধি, হৃদরোগ, কিডনি, লিভারসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্তরা করোনা সংক্রমিত হয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, নীরব ঘাতক ডায়াবেটিস আজ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে রীতিমত আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ডায়াবেটিস রোগটি এখন আর অপরিচিত কোনো রোগ নয়। দিনে দিনে এর প্রকোপের পাশাপাশি বৃদ্ধি পাচ্ছে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা এবং মৃত্যুঝুঁকিও। অথচ একটু সচেতন হলেই এ রোগ থেকে এবং ডায়াবেটিস হলেও এ রোগের জটিলতাকে সহজেই রুখে দেওয়া সম্ভব। ডায়াবেটিস জটিলতার কারণে মানুষের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, স্নায়ুরোগ, গর্ভকালীন জটিলতা ও কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় শরীরের অঙ্গ কেটেও ফেলতে হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী ডায়াবেটিসের জটিলতায় অনেক মানুষ প্রতিবছর অকাল মৃত্যুতে নিপতিত হচ্ছে। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানোসহ সুশৃঙ্খল জীবন প্রণালী বজায় রাখলে ডায়াবেটিসের নীরব আঘাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব বলে জানান অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, সারাবিশ্বেই ডায়াবেটিস এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। এ রোগ আজীবনের। একবার হলে তা কখনো সারে না। তবে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব।

তিনি বলেন, যথাযথ চিকিৎসা শিক্ষা পেলে একজন ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসকের ওপর নির্ভরশীল না থেকে রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। এ রোগের যেসব ঝুঁকি আছে তা এড়িয়ে চলতে পারেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম। কিন্তু আরও ভয়াবহ হলো ২০৩০ ও ২০৪৫ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে থাকবে। ডায়াবেটিস রোগীর পরবর্তী আজীবনের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা অতীব জরুরি।  ডায়াবেটিস কন্ট্রোল পরিমাপের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পরীক্ষা হলো রক্তের এইচবিএ-১সি, যারা ৩-৪ মাসের গড় হিসাব বোঝায়। প্রায় সব ডায়বেটিস রোগীর জন্য গড়পড়তা এইচবিএ-১সি-এর লক্ষ্য মাত্রা হলো -৭ শতাংশ।  কিন্তু সব মানুষই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কমবেশি ব্যর্থ। বাংলাদেশের বেলায় তা আরও হতাশাব্যঞ্জক।

বাংলাদেশের ৭৫-৮০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যেটিকে প্রতিরোধ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে (প্রতি ২ জনে একজনের ক্ষেত্রে), কিন্তু একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে বাকি জীবন ডায়াবেটিস নিয়েই কাটাতে হবে এবং প্রহর গুনতে হবে যে, কখন ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতাগুলো দেখা দেয়। তাই সর্বস্তরের মানুষকে সচেতনভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কর্মযজ্ঞে নিজের সামর্থ্য অনুসারে অংশগ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস চিকিৎসা যেমন জরুরি, তার চেয়েও ডায়াবেটিস প্রতিরোধের সর্বাত্মক সুগভীর কর্মকান্ড চালানো দরকার বলে জানান ডা. শাহজাদা সেলিম।

লক্ষণ ও  প্রতিরোধের উপায়সমূহ :

ডায়াবেটিসের বিভিন্ন লক্ষণসমূহ তুলে ধরে বাংলাদেশের ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ড. এ কে আজাদ খান  ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের-  টাইপ-১ ও টাইপ-২। আমাদের দেশে ৯৫ শতাংশ রোগী টাইপ-২ ধরনের। ‘টাইপ-১ হচ্ছে যাদের শরীরে একেবারেই ইনসুলিন তৈরি হয় না। তাদের ইনসুলিন বা পুরোপুরি ওষুধের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেজন্য সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। টাইপ-২ ধরণের ডায়াবেটিসের ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই আগেভাগে সতর্ক থাকলে, শারীরিক পরিশ্রম করলে এবং খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ আনলে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু একবার ডায়াবেটিস হয়ে গেলে আর এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না।

যে সব লক্ষণ দেখলে সতর্ক হতে হবে – ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া ও পিপাসা লাগা দুর্বল লাগা, ঘোর ঘোর ভাব আসা, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া, সময়মতো খাওয়া-দাওয়া না হলে রক্তের শর্করা কমে হাইপো হওয়া, মিষ্টি জাতীয় জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া, কোনও কারণ ছাড়াই অনেক ওজন কমে যাওয়া, শরীরে ক্ষত বা কাটাছেঁড়া হলেও দীর্ঘদিনেও সেটা না সারা, চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানি ভাব, বিরক্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা এবং চোখে কম দেখতে শুরু করা।

ঝুঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, যাদের বাবা-মা, ভাই-বোন বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের এই রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে। এছাড়া যারা নিয়মিত হাঁটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রম করেন না, অলস বা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন, তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এছাড়া নারীদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস রোগ হতে পারে। যাদের হৃদরোগ রয়েছে, রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যেসব শিশুর ওজন বেশি, যাদের বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস রয়েছে, যাদের মায়ের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়েছিল, সেই সব শিশুর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

ডায়াবেটিস প্রতিরোধের বিষয়ে ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, আগাম সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রতিদিন এক ঘন্টা হাঁটতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। জীবনধারা পাল্টে দিতে হবে। ধূমপান ও মদ্যপান ছেড়ে দিতে হবে। মিষ্টি খাওয়া যাবে না। রক্তে চিনির মাত্রার উপর নজর রাখতে হবে। বছরে অন্তত  একবার লিপিড প্রোফাইল এবং রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

আরো পড়ুন:

শীত মৌসুমে বাড়ে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব || বাঁচার উপায় জানালেন চিকিৎসকেরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *