লাইফস্টাইল

ডালুদের জীবন সংগ্রাম

বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ধূমকেতু ডটকম-এর বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। আজ প্রকাশিত হলো [৩য় পর্ব]। চোখ রাখুন ধূমকেতু ডটকম-এ।

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ‘ডালু’ অন্যতম। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও শেরপুরের নালিতাবাড়ি অঞ্চলে তাদের বসবাস। ডালুরা সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যালঘু। তাদের অনেকে মনে করেন মণিপুরিই হচ্ছে তাদের আসল ভাষা। তাদের কথাবার্তায় এমন কিছু শব্দ পাওয়া যায়, যা বাংলা ভাষায় নেই। অতীতে তাদের কোনো ভাষা থাকলেও এখন তা হারিয়ে গেছে। অনেকটা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এই জাতিগোষ্ঠী। ডালুদের দেবদেবী মূলত: হিন্দু লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীই – এতে কোনো পাথর্ক্য নেই।

বাংলাদেশে বসবাসরত ডালু সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত ও স্বচ্ছল পরিবারের কর্তা ব্যক্তি ছিলেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানাধীন জয়রামকুড়া গ্রামের গোবিন্দ ডালু। তার মারা যাওয়ার পর পরিবারটির হাল ধরেছেন ননী গোপাল ডালু। তিনি ও তার ছোট বোন পূর্ণিমা ডালু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।

ননী গোপাল ডালু ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে ডালু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। শোষণ-নির্যাতনের শিকার হয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক ডালু পরিবার ভারতে চলে গেছে। বর্তমানে দেশে ডালু জাতিসত্তার মোট জনসংখ্যা এক হাজারেরও কম। আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষার অবস্থাও ভেঙে পড়েছে। সব মিলিয়ে জীবন সংগ্রামেও টিকতে পারছে না ডালু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী।

খাদ্য ও পোশাক : 

খাদ্য ও পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়ে ননী গোপাল ডালু ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, ডালু পুরুষেরা ধুতি, জামা এবং মহিলারা নিজেদের তাঁতে তৈরি ‘পাথালি’ নামক এক ধরনের পোশাক পরিধান করে। তবে এখন তাদের অধিকাংশ পুরুষ শার্ট-প্যান্ট, লুঙ্গি এবং নারীরা শাড়ী, সেলোয়ার, কামিজ ইত্যাদি বাঙালি পোশাক পরিধান করে। খাদ্যের তালিকাতেও বাঙালি খাবার থেকে খুব বেশি আলাদা নেই।  ভাত, মাছ, শুঁটকি তাদের প্রধান খাবার হলেও কলার মোচা, বাঁশের কড়ল তাদের প্রিয় খাবার। শুকর, ছাগল, ভেড়া ও হাঁসের মাংসও খেয়ে থাকে। নিজেদের তৈরি পানীয় তাদের মধ্যে প্রচলিত।

সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্ম:

সমাজের পূর্বপুরুষ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে জানার বিষয়টি তুলে ধরে সরকারি চাকুরিজীবী পূর্ণিমা ডালু ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, ডালুরা পিতৃপ্রধান হলেও সন্তানরা মায়ের পদবি ধারণ করে। সংসার ও সমাজ পরিচালনায় পুরুষেরাই দায়িত্ব পালন করে থাকে। চিকাং, পিড়া ও যশী তাদের প্রধান গোত্র। গোত্রকে তারা দপকা বলে। এছাড়াও দরুং, নেংমা, কাড়া, মাইবাড়া, বাপার, কনা এবং শান্ধী নামে আরও ৭টি অ-প্রধান গোত্র আছে।

একই গোত্রের বিবাহ ডালু সমাজে নিষিদ্ধ। সনাতন ধর্মাবলম্বী ডালুরা গৌর, নিতাই ও মনসার পূর্জা করে। এছাড়াও অনেকে আদি দেবতা কেড়েং-কুড়ি-পথ-খাওরি দেব-দেবতার পূর্জা অর্চনা করে থাকে। ডালুরা হিন্দু উত্তরাধিকার আইনসহ জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। ডালুদের দেবদেবী মূলত: হিন্দু লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীই- এতে কোনো পাথর্ক্য নেই। হিন্দুরা যে সমস্ত দেবদেবীর পূজা অর্চনা করে থাকেন- ডালুরাও ওই সমস্ত দেবীদেবীর পূজা অর্চনা করে থাকেন।

ডালুরাই বর্তমানে হাজং, বানাই, কোচদের চেয়ে সর্বাপেক্ষা হিন্দুভাবাপন্ন। হিন্দু ঐতিহ্যের বাইরে নিজস্ব প্রথা, রীতিনীতি, পোশাক পরিচ্ছদ এমনকি লৌকিক ঐতিহ্যের প্রায় কোনো চিহ্ন বা স্মারক ডালুদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না।

অবস্থান :

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, ডালু সম্প্রদায়ের লোকেরা ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও নলিতাবাড়ী উপজেলার উত্তরাংশে মাত্র কয়েকটি গ্রামে ডালু নামক বাজারের সন্নিকটে গারো পাহাড়ের পাদদেশে আবহমান কাল ধরে বসবাস করে আসছে। জানা যায়, গত শতাব্দীর সূচনাকালে ময়মনসিংহ জেলায় প্রায় তিন হাজার ডালু ছিল। কালের পরিক্রমায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৈন্যদশায়- এদের জন্যসংখ্যা হাজারের নিচে নেমে গেছে। ডালুরা যে স্থানে বসবাস করে সেই স্থানটির নাম ডালুবাজার। ধারণা করা হয়, ডালু বাজার নামের সঙ্গে ডালুজাতির নামের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাই স্থানটির নাম ডালু বাজার হয়েছে। এই স্থান থেকেই পরবর্তীকালে বহু ডালু জাতি গারো পাহাড়ের উত্তরাংশে এবং গোয়ালপাড়া জেলার দক্ষিণ সীমান্তে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানান্তরিত ডালুরা এখনো ওই সমস্ত জায়গায় বসবাস করে।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ননী গোপাল ডালু ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, স্বাধীনতার আগে ও পরে বহুবার নির্যাতনের শিকার হয়েছে ডালু সম্প্রদায়। আত্মরক্ষা করতে ভারতে পালিয়ে গিয়ে দেশে ফিরে আসেনি অনেক ডালু পরিবার। যারা ফিরে এসেছে তাদের অধিকাংশই নিজেদের বেদখলে যাওয়া সহায়-সম্পত্তি ফিরে পাননি। যারা ফিরে পেয়েছেন তাদের অনেকেই বাঁচার প্রয়োজনে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। গ্রামের দখলদারদের হাত থেকে রেহাই পেতে তারাও গ্রামের জমি বিক্রি করে হালুয়াঘাট থানা সদরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ননী গোপাল ডালু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *