স্বাস্থ্য

ট্রমা আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় দরকার সংবেদনশীলতা

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: ট্রমা আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় সংবেদনশীলতা থাকতে হবে। ট্রমাটাইজড হওয়ার সঠিক কারণ চিহিৃত করে নিরাময় বা চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তারা বলছেন, ট্রমা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। ট্রমা ঘটে কোনো ঘটনা, ঘটনা গুচ্ছ বা এক গুচ্ছ পরিস্থিতি থেকে, যার ফলে একজন ব্যক্তি আবেগজনিত ক্ষতি বা প্রাণঘাতী অবস্থার মুখোমুখী হয়।

ট্রমা হলো প্রবল প্রভাব বিস্তারকারী মানসিক ও শারীরিক আঘাত। ট্রমার আঘাত বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ হতে পারে। শারীরিক ট্রমা একটি গুরুতর শারীরিক আঘাত, অন্যদিকে মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা একটি জীবন-হুমকি বা জীবন পরিবর্তনকারী ঘটনার অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া। শারীরিক ট্রমার আঘাত সাধারণত দৃশ্যমান হয়। আর মানসিক ট্রমা থেকে ব্যথা হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহজাবিন হক বলেন, ট্রমা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানুষসৃষ্ট কারণে হতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অনেক কারণ রয়েছে। আর মানবসৃষ্ট কারণেও অনেকের ট্রমা হয়। একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, সাভারের রানা প্লাজার ভেতরে অনেকে আটকা পড়ে ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছে। অনেকে উদ্ধার করতে গিয়ে আবার কেউ কেউ টিভিতে দেখেই ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছে। তাই বলা যায়, নিজে দেখে ও শুনে বা অভিজ্ঞতা শুনে ট্রমা হতে পারে।

অনেকে ট্রমা হলে মানিয়ে নেয়। হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে সে ভালোই তো আছে। কিন্তু আসলে সে ভালো নেই। যখন তার জীবনে কঠিন সময় আসে, তখনই দুর্বল হয়ে যাবে। অস্থিরতা অনুভব করবে। যেটা অন্য মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে, সেটা কিন্তু সে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে না। সেটার কারণে স্বাভাবিকভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না।

বেড়ে ওঠার সময়ও কিন্তু শিশুরা নানাভাবে ট্রমায় আক্রান্ত হয়। সব সময় যে বড় আঘাত এলেই ট্রমা হবে, সেটা কিন্তু না। একই সঙ্গে বিভিন্ন বয়সেই মানুষ কিন্তু ট্রমায় আক্রান্ত হতে পারে। বড় বয়সেও শারীরিক, মানসিক ও আবেগময় কারণেও ট্রমা হতে পারে। ট্রমা কিন্তু অনেক ক্ষতিকর। আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে ছোট শিশু বা মেয়েরা ‘চাইল্ডহুড সেক্সুয়াল অ্যাভিউস’–এর শিকার হচ্ছে। এই নিপীড়ন কিন্তু পরিচিত মানুষের হাতেই হয় বেশির ভাগ সময়। শিশুরা অনেক সময় ভয় পেয়ে যায়, অনেক সময় বোঝেই না যে তার সঙ্গে কী হচ্ছে। অনেক সময় বুঝলেও সে কারও কাছে বলে না। কারণ, এই বিষয় বললে দোষটা তার ওপরই আসবে। এগুলো পরে ট্রমা হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে হয়তো লেখাপড়ায় ভালো করেছে। সবার সঙ্গে মিশছে কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় আটকে যাবে। স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে না। তার হয়তো বাসে উঠতে সমস্যা হবে, বিয়ে করতে ভয় পাবে। বিয়ে হলেও স্বামীর সঙ্গে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে না। আমি বলব, শিশু বয়সের ট্রমাটা খুবই ভয়ানক। আমি আমার রোগীদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বড় বয়সে মানসিক রোগের বড় একটা কারণ কিন্তু শিশু বয়সে ট্রমা।

ট্রমা কাটানোর উপায়:

অধ্যাপক মেহজাবিন হক বলেন, ট্রমা থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে পারিবারিক সম্পর্কে। মা–বাবা হওয়া অনেক বড় একটি দায়িত্ব। চাকরি করলেও একটা বয়সের পর অবসরে যাওয়া যায়। কিন্তু মা–বাবার কোনো অবসর নেই। সব পেশায় যাওয়ার আগে মানুষ প্রশিক্ষণ নেয়। কিন্তু মা–বাবা হওয়ার আগে আমাদের দেশে কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। মা–বাবা হতে হলে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক—সব দিক থেকেই আপনাকে শতভাগ দিতে হবে। এটা আপনি কীভাবে করবেন, সেদিকে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। মা–বাবা বাইরের সব রাগ কিন্তু বাসায় এসে সন্তানের ওপর ঝাড়েন। কিংবা মা–বাবার সন্তানের কাছে এত বেশি চাওয়া থাকে, যা সন্তান অনেক সময় পূরণ করতে পারে না। বাবা হয়তোবা ডাক্তার হতে পারেননি, তাই তিনি সন্তানকে ডাক্তার বানাবেন। সন্তান দেখা গেল লেখালেখিতে ভালো। লেখালেখিতে গেলে সন্তান ভালো করবে। কিন্তু মা–বাবা তাকে তার বিরুদ্ধে জোর করেন। এটা অভিভাবকের করা উচিত না। সন্তানকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দিকে আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। সমাজের জন্য মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ বেশি দরকার। বর্তমানে আমাদের মূল্যবোধ ঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে না। ভালো ছাত্র হিসেবে তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ভালো মানুষ হিসেবে না।

পরিবার থেকে আমরাই কিন্তু শিখিয়ে দিচ্ছি, রাগ হলেই একজনকে মারা যায়। বাচ্চাদের খুব বেশি বলে শেখানো যায় না, তারা আশপাশ দেখে দেখে শেখে। এটা তাকে শেখাতে হবে। অনেককে দেখা যায়, কোনো একদিন লিফটে আটকা পড়েছেন এমন একজন ব্যক্তি ১৩ তলায় হেঁটে উঠেছেন, তবু লিফটে ওঠেননি। তার ভাবনা ও অনুভূতিতে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমনকি শারীরিক যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়—বুক ধড়ফড় করা, পিপাসা লাগা, হাত–পা ঘামা বা অস্থির হয়ে যাওয়া—সেগুলো কাটানোর জন্য মনোসেবা বা কাউন্সেলিং দরকার।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি) ডা. সাইমুন নাহার বলেন, মানসিক চাপের লক্ষণ, কারণ, সময়কাল, তীব্রতা ও অতীতে মানসিক আঘাত পাওয়ার ইতিহাস, বংশগত ইতিহাস, পূর্বে মানসিক রোগের ইতিহাস, শারীরিক রোগের ইতিহাস, মানসিক এবং শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশদ মূল্যায়নের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। তারপর, আক্রান্ত ব্যক্তির বিশেষ প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা পরিকল্পনা করা হয়। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হচ্ছে-   লক্ষণগুলো কমানো। সমস্যাগুলো মোকাবেলায় দক্ষ হতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা। আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। সাইকোথেরাপি অথবা ওষুধ অথবা উভয়ের সমন্বয়ে মূল চিকিৎসা করা হয়।

যেহেতু মানসিক আঘাতের কারণ, ব্যক্তিবিশেষের অভিজ্ঞতা এবং পরিণতি ভিন্ন হয় সেহেতু রোগের লক্ষণ এবং রোগীর প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসাপদ্ধতিও কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। সাইকোথেরাপির মাঝে ট্রমা ফোকাসড কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (কগনিটিভ প্রসেসিং থেরাপি, প্রোলং এক্সপোজার থেরাপি), ইএমডিআর (আই মুভমেন্ট ডিসেনসিটাইজেশন অ্যান্ড রিপ্রসেসিং) বেশ কার্যকর। কগনিটিভ প্রসেসিং থেরাপি- এর মাধ্যমে দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিজের এবং অন্যদের সম্পর্কে রোগীর নেতিবাচক চিন্তা- যেগুলো তার আচরণকে প্রভাবিত করছে এবং দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করছে সেগুলোকে শনাক্তকরণ ও সংশোধন করা হয়। এটি প্রতি সপ্তাহে ৬০-৯০ মিনিট করে মোট ১২ সপ্তাহ ধরে দিতে হয়। প্রোলং এক্সপোজার থেরাপি- রোগীর সঙ্গে কথা বলে তার মানসিক আঘাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানা হয় এবং তার ভয়ের উৎস খুঁজে বের করা হয়। তারপর তাকে ধাপে ধাপে ভয়ের উৎসগুলোকে মোকাবেলা করে ভয়কে জয় করতে শেখানো হয়।

এছাড়া প্রগ্রেসিভ মাসকিউলার রিলাক্সেশন, ব্রিদিং রিলাক্সেশন ইত্যাদি ব্যায়াম খুব কার্যকর। ওষুধের মাঝে সিলেকটিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনিহবিটর্স (SSRI), পিটিএসডি এর চিকিৎসায় কার্যকর। এর মাঝে সারট্রালিন এবং পেরোক্সেটিন এফডিএ (FDA-U.S) অনুমোদিত। এগুলো পিটিএসডি রোগীর বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, রাগ ইত্যাদি কমাতে সাহায্য করে। তাছাড়া রোগীর নিদ্রাহীনতা, অস্থিরতা, সন্দেহপ্রবণতা ইত্যাদি কমাতে কিছু এন্টিসাইকোটিক (যেমন ওল্যানযেপাইন, কিউটিয়াপাইন, রিসপেরিডোন) ইত্যাদি কার্যকর। ঘুমের সমস্যা দূর করতে এবং রোগীকে প্রশান্ত করতে বেন্জোডায়াজেপাইন ব্যবহার করা যায় তবে সেগুলোতে নির্ভরশীল হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

সাইকোথেরাপি শুরু করার আগে অথবা চলাকালীন সময়ে ওষুধ গ্রহণ করলে চিকিৎসা বেশি কার্যকর হয়। রোগী/দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিকে সংকটাবস্থা থেকে নিরাপদ অবস্থায় আনার পর পিটিএসডি-এর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা শুরু করা উচিত। মাদকাসক্তি, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার প্রবণতা, প্যানিক ডিসঅর্ডার ইত্যাদি থাকলে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলোর চিকিৎসা করতে হবে।

চিকিৎসা প্রদানের সময় যে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে সেগুলো হল- রোগীর কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। রোগীর প্রতি সহমর্মী হতে হবে, তাদের অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।সর্ব প্রকার গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে এমন কোনো কথা বলা বা কাজ করা যাবে না যাতে রোগী আবার আঘাত পায়।

আরো পড়ুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *