অভিমত

জেল হত্যা : বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে জাতীয় চার নেতার অবস্থান চির ভাস্বর, চির জাগ্রত

তাপস হালদার:

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। জেলখানাই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান, আর সেখানেই ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং খাদ্য ও ত্রাণ মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কী অপরাধ ছিল স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী বীর সন্তানদের? তাঁদের অপরাধ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে কোনো আপোস করেননি, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি, খুনী সরকারকে সমর্থন করেননি। এটাই তাঁদের অপরাধ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এই চারটি নাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িত।বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে গেলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব তাঁরাই নেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে, ছিনিয়ে এনেছিলেন লাল সবুজের পতাকা।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে চিরতরে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে জাতীয় চার নেতাকে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যখন চার নেতাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেও কোনভাবে নেয়া যাচ্ছিল না, যখন বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে লোভ-লালসা ত্যাগ করে মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন, তখন খুনী চক্র ২২ আগষ্ট জাতীয় চার নেতাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁরা যাতে প্রতিরোধ গড়তে না পারেন সেজন্যই ঘাতক চক্র সেদিন পাশবিক হত্যাকান্ড চালায়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দোসররা জাতীয় চার নেতার উপর কতটা ক্ষুব্ধ ছিল যে শুধু গুলি করেই হত্যা করেনি, গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের পরাজয়ের গ্লানি মিটিয়েছে। এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকান্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতার অংশ। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের নাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। এটি নিছক কোনো হত্যাকান্ড নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধ্বংস করার জন্য হত্যাকান্ড। বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকান্ডের সাথে জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা আছে- সেটার প্রমাণ আত্মস্বীকৃত খুনিদের সাক্ষাৎকার থেকে বেরিয়ে এসেছে। জেল হত্যাকান্ডের পরই লালবাগ থানায় একটি মামলা হয়েছিল। কিন্তু ৭ নভেম্বর ক্যু করে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর এই মামলা আর আলোর মুখ দেখেনি।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত হয়। বিচারের স্বাভাবিক নিয়মে দীর্ঘ আট বছরেরও বেশি সময় বিচার কার্য চলার পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ২০ জন আসামীর মধ্যে ৩ জনের মৃত্যুদন্ড, ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ৫ জনকে খালাস দেন। ২০০৮ সালের ২৮ আগষ্ট হাইকোর্ট কেবলমাত্র রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে বাকি দুজনসহ যাবজ্জীবন প্রাপ্ত চার আসামীকে খালাস দেন। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল আপীল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে। অর্থাৎ পলাতক তিন আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার মোহম্মদ আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদন্ড এবং অন্য ১২ আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। অবশ্য মামলায় খালাস পেলেও লে.কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে.কর্নেল (অব) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা ও লে.কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত হওয়ায় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারী মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারে নি। পরাজয়ে প্রতিশোধ নিতেই তারা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির পিতার অবর্তমানেও যাতে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, স্বাধীনতার আদর্শ যাতে ব্যর্থ হয়,পাকিস্তানী ভাবধারায় যাতে বাংলাদেশকে তৈরি করা যায় সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জাতীয় চার মহান নেতাকে হত্যা করা হয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতার লোভ নয়, কাপুরুষতা নয়, আদর্শকে বুকে ধারণ করে হাসি মুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে জাতীয় চার নেতা মহান উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। মৃত্যুই তাঁদেরকে ইতিহাসে অমরত্ব দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর একে একে অনেক নেতা ক্ষমতার লোভ ও অসহায় কাপুরুষত্ব দেখিয়েছিলেন সেখানে জাতীয় বীর মহান চার নেতা মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে তাঁদের অবস্থান চির ভাস্বর, চির জাগ্রত।

জেলহত্যা মামলায় আসামীদের বিচারকার্য শেষ হলেও এখনও খুনীদের বিচারের রায় কার্যকর করা যায়নি।তাদেরকে দ্রুত খুঁজে বের করে রায় কার্যকর করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। ইতিহাসের প্রয়োজনে নেপথ্যের কুশীলবদের চেহারা জাতির সামনে উন্মোচন করা এখন সময়ের দাবী।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল :haldertapas80@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *