স্বাস্থ্য

জেলা-উপজেলায় বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার পরিধি বাড়াতে হবে

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার উচ্চ ব্যয়ের চাপ কমাতে সরকারি উদ্যোগে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে। তার চাপ গিয়ে পড়ছে বিনামূল্যে বা নামমাত্র খরচে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় অনেক গুণ বেশি চিকিৎসা খরচ হয়ে থাকে বেসরকারি হাসপাতালে। আর্থিক সঙ্কটে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর অকালে মৃত্যুর ঘটনাও বিরল নয়।

হু হু করে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হেলথ ইকোনমিকস এ্যান্ড ফিন্যান্সিং রিসার্চ দলের প্রধান জাহাঙ্গীর এ এম খান বলেন, স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজে বহন করে। ২৬ শতাংশ ব্যয় বহন করে সরকার। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও ব্যবসায়িক বীমা কোম্পানি বহন করে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে চার শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা রবার্ট ইয়েটস বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ বেশি হবে, না কম হবে তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তিনি বলেন, যেসব দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার পথে অগ্রসর হয়েছে বা কিছু সাফল্য অর্জন করেছে তা মূলত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ফলে।

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাব্যয়:

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালে। অপারেশন, সিসিইউ, আইসিসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবার ক্ষেত্রে কোনও টাকা নেয়া যাবে না। তবে বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফি নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও সরকারি ফি বেসরকারি হাসপাতালের ফির তুলনায় অনেক গুণ কম। সরকারি হাসপাতালে করোনারি এনজিওগ্রামে ২ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ২ হাজার টাকা, এমআরআই ৩ হাজার টাকা, ইসিজি ৮০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ২০০ টাকা, এক্সরে ২০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ৩০০ টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ২ হাজার টাকা, ইউরিন ৩০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ১০০ টাকা। সকল হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। এই মুহূর্তে কোনও ঘাটতি নেই।

বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ :

বেসরকারি হাসপাতালসমূহের চিকিৎসাসেবার খরচ অনেকটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতিটি অপারেশনে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা লাগে। প্রতিদিন সিসিইউ সেবা পেতে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং আইসিইউ সেবা পেতে লাগে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সেশনে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। এভাবে করোনারি এনজিওগ্রামে ১৫ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, এমআরআই ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা, ইসিজি ৩০০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, এক্সরে ৫০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ১ থেকে ৩ হাজার টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ১৫ হাজার টাকা, ইউরিন ২০০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ৪৫০ টাকা।

চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ যা বলেন:

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের  (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ও উন্নয়ন অতুলনীয় এবং বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। কেন্দ্র থেকে মফস্বল পর্যন্ত তথ্য প্রযুক্তিতে সাজানো হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার এমন অবকাঠামো বিশ্বের কোথাও নেই।

তিনি বলেন, দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যয় বিবেচনায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। দেশের বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান চালু রাখা অনেক ব্যয়বহুল। তাই ওই সব প্রতিষ্ঠানে খরচও অনেক। তবে থানা স্বাস্থ্য  কমপ্লেক্সগুলোতে সীমিত পরিসরে হলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সার্জারি নিশ্চিত করা গেলে সাধারণ মানুষের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার স্রোত হ্রাস পেত।

ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদী-ই মাহবুব  ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, সরকারি উদ্যোগ জেলা ও থানা পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়াতে হবে। থানা পর্যায়ে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলে মানুষ অর্থ ব্যয় ও কষ্ট করে জেলা পর্যায়ে যাবে না। আর জেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত সরকারি ব্যবস্থা থাকলে বিভাগীয় পর্যায়ে যাবে না। এটা তো সহজ হিসাব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দীন আহমেদ ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারে না মানুষের সংখ্যা কম নয়। সারাদেশে নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা প্রদান, ওষুধ বিতরণ, রোগীদের খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সেবা দিয়ে যাচ্ছে সরকার। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত। সরকারি উদ্যোগে থানা পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত হলে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে রোগীদের যাওয়া কমে যাবে।

স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য:

স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা কয়েকগুণ বেড়েছে। অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় কোনও জাতীয় দিকনির্দেশনা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে নেই কোনও ব্যবস্থাপনা। প্রথমবারের মতো এ জাতীয় রোগ নিয়ে বিশেষ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিজেদের মতো করে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এ জাতীয় রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে বিশেষ কার্যক্রম সাজাতে গিয়ে পদে পদে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে কমছে, দ্রুত বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসাব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের সামর্থের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর অনেক অসংক্রামক রোগের শতভাগ চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে নেই। তাই অনেক অসংক্রামক রোগীকে চিকিৎসার অভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে।বর্তমানে দেশের শতকরা ৬১ ভাগ রোগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগ।

আরো পড়ুন:

দেশের ৩৯% মানুষ করোনা টিকার ১ম ডোজ ও ২৩% ২য় ডোজ পেয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *