জীবন ও পরিবার

জীবিকা সংকটে শান্তিপ্রিয় খুমিরা || দরকার বিত্তবানদের সহযোগিতা

বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ধূমকেতু বাংলা’র বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। আজ প্রকাশিত হলো ১৫তম পর্ব।

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে একটি হলো খুমি। বাংলাদেশর বান্দবান জেলায় এবং ভারত ও মায়ানমারে তাদের বসবাস রয়েছে। তাদের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। নিজস্ব ভাষা থাকলেও বর্ণমালা নেই। বাংলাদেশে তাদের মোট জনসংখ্যা তিন হাজারেরও কম। তারা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। জুম চাষ কমে যাওয়ায় জীবিকা সংকটে পড়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী খুমিদের অনেকে বৌদ্ধ ও খ্রীষ্ট খুমিদের ধর্ম গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশে বসবাসরত খুমি সম্প্রদায় নিয়ে যৌথ গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সাদেকা হালিম ও খুমি সামাজিক সংগঠন খুমি কুহুংয়ের নেতৃবৃন্দ। গবেষণায় দেখা যায়, খুমিদের মাসিক আয় খুবই কম, যা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা অত্যন্ত কষ্টের। গড়ে একটি খুমি পরিবারের মাসিক আয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ পরিবারগুলোর গড় আয়ের তিন গুণ কম। দারিদ্র্যের কারণে ৬৫ শতাংশ খুমি শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে এবং ৮৮ শতাংশ খুমিই নিরক্ষর।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, খুমি সম্প্রদায়ের সার্বিক অবস্থা ভালো না। জীবন-জীবিকা ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে তারা যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। জাতীয় উন্নয়নের ছোঁয়া তাদের গায়ে লাগে না। তারা  শিক্ষা ও অর্থনেতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। তারা শান্তিপ্রিয় ও সরল স্বভাবের। দু’বেলা খেয়ে দিন পার করতে পারলেই তারা খুশি।

সঞ্জীব দ্রং আরও জানান, খুমিদের মূল জনগোষ্ঠীর বসবাস মায়ানমারে। ১৭শ শতকের শেষভাগে খুমি উপজাতি আরাকান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করে। বাংলাদেশে তারা বান্দরবান জেলার রুমা, রৌয়াংছড়ি এবং থানচি উপজেলাতে বসবাস করে। তবে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতেও কিছু সংখ্যক খুমি পরিবার রয়েছে।

সাংবাদিক লোঙা খুমি জানান, সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও বঞ্চিত হচ্ছে খুমিরা। তাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজার। ২০১৪ সালে একটি বেসরকারি সংস্থা দ্য সোসাইটি ফর এনভারনমেন্ট এণ্ড হিউম্যান ডেভেলাপমেন্ট (সেড) পরিচালিত খুমিদের আর্থ-সামাজিক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে খুমিদের সংখ্যা ২,৮৯৯ জন। খুমিদের মোট জনসংখ্যার ৫১.২২ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৮.৭৮ ভাগ নারী। তাদের স্বাক্ষরতার হার ২৮.২০ শতাংশ। তাদের অধিকাংশ পরিবার জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা শিক্ষা ও অর্থনেতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে।

শিক্ষা:

বান্দবানের থানচি উপজেলার সিরি খুমি ধূমকেতু বাংলাকে জানান, আগের তুলনায় খুমি জাতির মধ্যে স্বাক্ষরতা ও শিক্ষার হার বেড়েছে। সে আলীকদম উপজাতীয় আবাসিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। তার বাড়ি থানচি উপজেলার দুর্গম তিন্দুতে। খুমিদের মধ্যে প্রথম স্নাতক উত্তীর্ণ লেলুং খুমি বলেন, শিক্ষার হার বাড়লেও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তারা সবাই দুর্গম এলাকায় বসবাস করে এবং তাদের মা-বাবা খুবই দরিদ্র।

লেলুং খুমি বলেন, বিত্তবান ও মানবতাবাদীরা সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলে পিছিয়ে পড়া খুমি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে পারবে। না হলে এসএসসি উত্তীর্ণ অধিকাংশ ছেলেমেয়ের ঝরে পড়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালে বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র জাতিসত্তার খুমি সম্প্রদায়ের দুই ছাত্র প্রথমবারের মতো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। তাদের  মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিক ডিজাইনে সুইতং খুমি এবং সিলেট শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় অংহো খুমি ভর্তি হতে পেরেছেন। সুইতং খুমি মেধাতালিকায় ও অংহো খুমি উপজাতীয় কোটায় সুযোগ পেয়েছেন।

পোশাক-পরিচ্ছিদ:

খুমিদের পোশাক পরিচ্ছদেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। বাঙালি পরিবেশে তাল মিলিয়ে পোশাক পরিধানেও অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তারা। তবে খুমি নারীরা রূপার অলঙ্কার পরতে ভালবাসে। খুমি সমাজের নারী পুরুষ উভয়কেই সাদা কাপড়ের পাগড়ী পরতে দেখা যায়।

রীতিনীতি ও উৎসব:

খুমি সামাজিক সংগঠন খুমি কুহুংয়ের সভাপতি সিয়ং খুমি বলেন, খুমিরা দুটি দল বা গ্রোত্রে বিভক্ত। একটি হলো ‘আওয়া খুমি’ অপরটি ‘আহংরাজ খুমি’। খুমিদের রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক বিধি-বিধান। গোষ্ঠীগত সমাজ জীবনে যে কোনও সামাজিক বিচার ও জরিমানা করার ক্ষমতা গোষ্ঠী প্রধানদের আছে। তাদের অভ্যাস, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ ও জীবনধারার সঙ্গে ম্রোদের মিল পাওয়া যায়। খুমি সমাজে ম্রো সমাজের মতো কান ছিদ্র করার প্রথা আছে। তবে ম্রোদের মতো কোনও আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয় না। খুমিরা বছরে দুইবার নবান্ন উৎসব আয়োজন করে। নারীরা রূপার অলঙ্কার পরতে ভালবাসে। নারী পুরুষ উভয়কেই সাদা কাপড়ের পাগড়ী পরতে দেখা যায়। এ সাদা পাগড়ীকে খুমীরা ‘লুপ্যা’ বলে। বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও সনাতন -এই তিন ধরনের ধর্মানুসারী খুমি সমাজে রয়েছে। তাদের প্রচলিত উৎসবের বাইরে শিকার প্রাপ্তির আনন্দে আয়োজিত উৎসব, ‘গো-হত্যা’ উৎসব, সাংক্রাই, বড়দিন ও পুনরুত্থান  উৎসব, আংওয়াং- য়ানা, পাড়াবন্ধ ইত্যাদি উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়।

আগে খুমি পুরুষরা সাধারণত নিম্নাঙ্গে সুতা বা পশুর লোমের তৈরি লম্বা সাদা কাপড় পরিধান করত। এই কাপড়  এরা  লেংটির মতো করে পরত। শরীরের সামনের ও পিছনের দিকে লেংটি ঝুলানো থাকত। মাথায় সাদা পাগড়ি জাতীয় কাপড় বেঁধে রাখত। খুমি মেয়েরা ওয়াঙলাই নামে ৯-১৪ ইঞ্চি চওড়া আকারের কাপড় নিম্নাঙ্গে পরত। তারা নিজেদের পোশাক লেংটি এবং ওয়াঙলাই নিজেরাই বয়ন করত।

খাদ্য:

খুমি সামাজিক সংগঠন খুমি কুহুংয়ের সভাপতি সিয়ং খুমি বলেন, খুমিরাও বাঙালি খাবারে অভ্যস্ত হযে পড়েছে। ভাত, মাছ, মাংস ও শাক-সবজি খেয়ে থাকে। বন্য ফলমূল আহার করলেও তারা এগুলো চাষ করার পরিবর্তে জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে। তারা বন্যপশু খেতে পছন্দ করে। মদ তাদের সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অংশ। সাধারণত ভাত পচিয়ে তারা মদ তৈরি করে। ধর্মীয় এবং সামাজিক বিভিন্ন কাজে এবং অনুষ্ঠানে মদ্যপানের রেওয়াজ আছে।

খুমি উত্তরাধিকারের সাধারণ নীতি

সাংকিং কার্বারিপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা থানলে খুমি ধূমকেতু বাংলাকে জানান, খুমি সমাজভুক্ত পরিবারের কেউ মারা গেলে তার সৎকার, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের বেলায় সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সমাজের অনুশাসন অনুসারে মৃতের আত্মার সদ্গতির জন্য বিশেষ কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হতে হয়। মৃত ব্যক্তির সৎকার/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) জীবদ্দশায় সম্পাদিত উইল বা দানমূলে দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়-দেনা মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে, তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তায়। এ সকল দায়-দাবি না মিটিয়ে সম্পত্তির মালিকের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না।

সম্পত্তির মালিক যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রেখে মারা যান সে সবই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য। অস্থাবর সম্পত্তি যেমনঃ- আসবাবপত্র, থালা-বাটি, কাপড়চোপড়, অলংকার, গবাদিপশু ইত্যাদি উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে আপোষ রফায় ভাগবন্টন হয়। কিন্তু লিখিত কোনো আইন বা বিধিবিধানমতে সেগুলো ভাগবন্টন করা হয় না। শুধু ভূমি তথা জায়গা-জমিকে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে সামাজিক বিধি-বিধানমতে ভাগবন্টন করা হয়। তাই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি বলতে সাধারণভাবে স্থাবর সম্পত্তিকেই বুঝানো হয়। কিন্তু একজন সম্পত্তির মালিকের সম্পূর্ণ স্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না। সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর তার সৎকার/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়/দেনা মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তায়।

জীবিকা সংকট:

জুম খেতে ফলন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় শতভাগ জুমচাষ নির্ভর বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার খুমি আদিবাসীরা জীবিকার সংকটে পড়েছে। তারা জুম চাষের বিকল্প উপায়ও খুঁজে পাচ্ছে না। সড়কের পাশে বসবাস করেন খুমি সম্প্রদায়ের এমন অনেকে এখন জুম চাষের পাশাপাশি ফলদ ও বনজ বাগান করছেন। তবে ফলদ-বনজ বাগানকেও তারা জুম চাষের বিকল্প হিসেবে নিতে পারেনি।

রোয়ংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নে বসবাসরত খুমি সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, জুমের ফলন বিগত ১০-১২ বছরে দ্রুত কমে গেছে। সার প্রয়োগ করে কয়েক বছর উৎপাদন কিছুটা ধরে রাখা গেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবার কমতে শুরু করে। দুই-তিন বছর থেকে ধানের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। পাশাপাশি জুমের জমির ওপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, বনভূমি ধ্বংস, বনায়নের নামে বন বিভাগের এক প্রজাতির বৃক্ষের বাগান সৃজন ও ব্যাপক হারে পাহাড়ি জমি দখলের কারণে জুমের ফলন কমে গেছে বলে খুমি সম্প্রদায়ের লোকজন জানান।

রোয়াংছড়ির সাংকিংপাড়ার কার্বারি (পাড়া প্রধান) সাংকিং কার্বারি বলেন, ২০-২৫ বছর আগে কোনো সার প্রয়োগ না করে জুমে এক আড়ি (১০ কেজি) ধানের বীজ রোপণ করলে ৮০-৯০ আড়ি ধান উৎপাদন হত। বর্তমানে সার প্রয়োগ করে এক আড়ি বীজ বুনে জুম খেত থেকে ১৫-২০ আড়ি ধানও পাওয়া যায় না। জুমে রাসায়নিক সার ও আগাছানাশক ব্যবহার করায় মাটির উর্বরতা কমে গেছে। পাশাপাশি পাহাড়ের বড় বৃক্ষ নির্বিচারে নিধনের ফলে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল না থাকায় জুমের ফলন কমছে বলে মনে করেন তিনি।

সাংকিং কার্বারিপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা থানলে খুমি বলেন, রোয়াংছড়ি উপজেলায় বসবাসরত পাঁচটি খুমিপাড়ার কয়েকটি পরিবার ছাড়া কেউ জুম খেত থেকে সারা বছরের খোরাকি উৎপাদন করতে পারেনি। জুম চাষের পাশাপাশি বিকল্প জীবিকার উপায় খুঁজে বের করা না গেলে তারা আরও বেশি সংকটে পড়বেন বলে তিনি জানান।

খুমি সামাজিক সংগঠন খুমি কুহুংয়ের সভাপতি সিয়ং খুমি বলেন, রোয়াংছড়িতে পাঁচটি পাড়ায় ৮১-৮২টি পরিবারসহ জেলার তিনটি উপজেলায় মাত্র আড়াই হাজারের মতো খুমি আদিবাসীর বসবাস রয়েছে। জুমের ফলন কমে যাওয়ায় শুধু রোয়াংছড়ি নয়, জুম চাষনির্ভর প্রায় সব খুমিই কমবেশি জীবিকার সংকটে পড়েছে।

আরো পড়ুন:

তঞ্চঙ্গ্যাদের আছে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *