প্রচ্ছদ

জীবন বাঁচিয়ে রেখেছে বাঁশি

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: ব্যস্ত রাস্তার পাশে বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন সিরাজুল ইসলাম। বাঁশের বাঁশির মোহনীয় সুর ভাসছে বাতাসে। হৃদয় দোলানো সেই সুরে তাকে ঘিরে জমে উঠছে মানুষের ভিড়। তন্ময় হয়ে শুনছেন সবাই। কখনও একটু থামতেই অনুরোধ আসছে আবারও বাঁশি বাজানোর। তাদের কারও আগ্রহ বিচ্ছেদের সুরে, কারও বা আনন্দের সুরে। প্রতিদিন এমন আনন্দ-বেদনার সুর বাজিয়ে ও বাঁশি বিক্রি করেই নিজের জীবনকে জাগিয়ে রেখেছেন ৭৮ বছর বয়সী বংশীবাদক সিরাজ।

ময়মনসিংহ নগরীর বলাশপুর শ্মশান এলাকায় দেখা হয় বংশীবাদক সিরাজের সঙ্গে। তার বাড়ি অবশ্য জেলার গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের পাঁচাশি গ্রামে। নগরীর শম্ভুগঞ্জ সেতু-সংলগ্ন এলাকার একটি দোকানে বসে তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। তাকে ঘিরে তসর বাঁশির সুর শুনছিলেন বৃদ্ধ শামছুল হক, রফিক মিয়া ও মোহাম্মদ আলীসহ অন্যরা। সিরাজের নানা সুরের সঙ্গে নানা বয়ানও করা হয় সুরের। দুই মেয়ে ও দুই ছেলের জনক সিরাজ বাঁশির এ জগতে ডুব দেন ১৯৭১-এ।

সিরাজুল ইসলাম জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এতদিন বাজারঘাট বন্ধ ছিল। চলত না যানবাহনও। তার বাঁশি শোনেন ও কেনেন হাটবাজারের মানুষজন। কিন্তু সেই হাটবাজার বন্ধ থাকায় তিনিও কাটান গৃহবন্দি জীবন। লকডাউনের পুরোটা সময়ই তার স্ত্রীকে নিয়ে কেটেছে ঘরে বসে, ধুঁকে ধুঁকে। জমানো সব টাকা খরচ হয়ে গেছে, নতুন করে ঋণ হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা!

লকডাউন তুলে নেওয়ায় এখন আবার বাঁশি নিয়ে পথে বেরিয়েছেন সিরাজুল। ভাগ্য ভালো থাকলে তিনি দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার বাঁশি বেঁচতে পারেন। আবার কোনো কোনো দিন খালি হাতেও ফিরতে হয় বাড়ি। এভাবে যা রোজগার করেন, তা নিয়ে স্ত্রী সুফিয়া খাতুন আর তিনি জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন। স্ত্রীর জন্য নিয়মিত ওষুধও কিনতে হয় তাকে।

সিরাজ ও সুফিয়ার অবশ্য দুই ছেলে আর দুই মেয়ে আছেন। বড় ছেলে হানিফ মিয়া ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ছোট ছেলে উমর ফারুক কৃষক। দুই মেয়ে মারুফা ও সাহিদা এখন স্বামীর সংসারে। বিয়ে করার পর দুই ছেলেই আলাদা সংসার পেতেছেন। ছোট ছেলে উমর ফারুক অবশ্য তাদের মাঝে মাঝে সহযোগিতা করেন। কিন্তু জীবনের ঘানি টেনে বেড়াতে হচ্ছে মূলত আশি ছুঁই ছুঁই সিরাজুলকেই।

সিরাজ জানান, বাঁশির হাতেখড়ি তার বোকাইনগর গ্রামের আবদুল হামিদের কাছে। বাঁশি বানাতে ও বাজাতে ওস্তাদ এই মানুষটি প্রয়াত হয়েছেন অনেক আগেই। তার কাছ থেকেই সিরাজ শিখেছেন বাঁশি, কল বাঁশি, মোহন বাঁশি, টিপরা বাঁশি, পাখি বাঁশি, নাগিনি বাঁশি, কর্নেড বাঁশি ইত্যাদি বানাতে। হাটবাজার ও পথেপ্রান্তরে হেঁটে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টাকায় নিজের তৈরি বাঁশি বিক্রি করেন তিনি।

কিন্তু সময় পাল্টে গেছে, ৩০-৪০ বছর আগেও বাঁশির যে কদর ছিল, এখন আর তেমন নেই। বাঁশির রাগ মানুষকে এখনও আন্দোলিত করে, কিন্তু যান্ত্রিকতার কাছে বাঁশির মূল্য নেই। বাঁশি বাজাতে আগ্রহী মানুষও যেন কমে আসছে। তবে বর্তমানে উঠতি বয়সী তরুণদের কেউ কেউ এখনও শখ করে বাঁশি কেনেন তার কাছ থেকে।

সিরাজ ময়মনসিংহ শহর ছাড়াও আশপাশের উপজেলাগুলোতে নিয়মিত যান বাঁশি বেচতে। বাঁশির একটি পাঠশালাও রয়েছে বাড়িতে। প্রতি শুক্রবার কয়েকজন এক ঘণ্টার জন্য বাঁশি শিখতে যান তার কাছে। দুই মাসের মধ্যেই বাঁশি বাজানো শিখিয়ে দিতে পারেন তিনি। এসব করে যা আয় হয়, তা দিয়ে জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। বাঁশির জোরেই এখনও জেগে আছে তার জীবন, এখনও বেজে উঠছে তার জীবন।

সত্তর বছর বয়সী শ্রোতা শামছুল হক বলেন, সিরাজের বাঁশির সুরে বড্ড মায়া। বহু বছর ধরে তাকে বাঁশি ফেরি করতে দেখছি। কিন্তু জীবনের কোনো পরিবর্তন হয়নি তার। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও বাঁশি নিয়ে হাটে ফেরি করতে হয় তাকে। জীবনের সুর আর বদলায়নি তার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *