নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: ইলিশের কৃত্রিম প্রজননে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। পুকুরে ইলিশ চাষের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এবার ‘অন বোট ব্লিডিং’ পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। প্রজনন মৌসুমে সাগরে থাকা জাহাজে মিনি হ্যাচারি তৈরি করে জীবিত পুরুষ ও স্ত্রী ইলিশ রেখে গবেষণা করা হচ্ছে। এ পদ্ধতি সফল হলে নদীতে ছাড়া যাবে ইলিশের পোনা। এতে বাড়বে উৎপাদন। এ কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি নিয়ে বেশ আশাবাদী বিজ্ঞানীরাও।

১৯৮৮ সালে সরকারি অর্থায়নে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুরের নদী কেন্দ্রের দুটি পুকুরে ইলিশ চাষের প্রথম উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সে সময় ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৯৫ সালে সেই প্রকল্প বাতিল করা হয়। এরপর ২০০৪-০৫ অর্থবছরে পুকুরে ইলিশ চাষ বিষয়ে গবেষণা হয়। কিন্তু তখনও তেমন সফলতা আসেনি। এরপর ২০১০-১১ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও গবেষণা’ প্রকল্পের অধীনে গবেষণা শুরু হয়। তখন গবেষণার জন্য নদী-সাগর থেকে ৮-১২ সেন্টিমিটার আকারের দুই হাজার ২০০ ইলিশের পোনা সংগ্রহ করে ইনস্টিটিউটের তিনটি পুকুরে ছাড়া হয়।

এর এক বছর পর মাছগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায়, মাছের বৃদ্ধির হার খুবই কম। ডিমগুলোও অপরিপক্ক। পরবর্তী সময়ে ২০১৫-১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ফিশ সংস্থার ইকোফিশ প্রকল্পের অধীনে ইউএসএইডের অর্থায়নে আবারও গবেষণা শুরু হয়। কিন্তু সেটিও সফল হয়নি।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (নদীকেন্দ্র) ড. আনিছুর রহমান বলেন, আমরা ২০১০-১১ অর্থবছরে নদী ও সাগর থেকে ৮-১২ সেন্টিমিটার আকারের ইলিশের পোনা এনে ইনস্টিটিউটের পুকুরে ছাড়ি। এক বছরের মধ্যে ওই মাছগুলো বেড়ে প্রায় ৩০০ গ্রাম হয়। এ সময়ে নদী ও সাগরে থাকলে ইলিশগুলোর ওজন হতো ৪৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম।

গবেষণার সময় পুকুরে থাকা মাছের পেটের ডিমও আমরা দেখি। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা যায়, ডিমগুলো অপরিপক্ক। পুকুরে চাষ করা ইলিশ সম্পূরক খাবার খায় না। প্রাকৃতিক খাবার খায়। ওই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ের গবেষণায় পুকুরের ইলিশগুলো প্রাকৃতিক খাবার তৈরি করে দিয়ে দেখেছি। এর ফলে আগের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও তা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার মতো নয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে হলে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে, পুকুরে ইলিশ চাষ একেবারেই অসম্ভব নয়। এখনও চাইলে যে কেউ পুকুরে ইলিশ চাষ করতে পারবেন। ৮-৯ মাস টিকে থাকবে সে ইলিশ, সর্বোচ্চ ৫০০ গ্রামের মতো ওজন হবে।

‘অন বোট ব্লিডিং’ পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রজনন অঞ্চল বাছাই করে জীবিত পুরুষ ও স্ত্রী ইলিশ ধরে জাহাজের হ্যাচারিতে রাখা হচ্ছে। হরমোন ইনজেকশন দিয়ে স্ট্রিপিংয়ের মাধ্যমে অথবা স্বাভাবিক উপায়ে পরিপক্ক করে পুরুষ ইলিশ থেকে স্পার্ম বের করে ট্রায়াল দিচ্ছি। এরই মধ্যে ফার্টিলাইজেশন (নিষিক্তিকরণ) হয়েছে। সাধারণত ফার্টিলাইজেশনের পর ১৬টি ধাপ পার হলে ইলিশের পোনা নদীতে ছাড়ার উপযোগী হয়। কিন্তু নবম ধাপ পর্যন্ত আসার পর আর তাদের টিকিয়ে রাখতে পারছি না। পোনাগুলো মারা যাচ্ছে। আমাদের আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ পদ্ধতির সফলতা নিয়ে আমি আশাবাদী।

অন বোট ব্লিডিং পদ্ধতির বিষয়ে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ইলিশের কৃত্রিম প্রজনন খুবই স্পর্শকাতর। ইলিশের প্রজনন রুই-কাতল কিংবা অন্য মাছের মতো নয়। আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সফল হতে পারিনি। ইলিশের আসল স্বাদ-গন্ধ রেখে কৃত্রিম প্রজনন একটু কঠিন। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি। সর্বশেষ কৃত্রিম প্রজননের জন্য অন বোট ব্লিডিং পদ্ধতি ব্যবহার করছি। জাহাজের মধ্যেই মিনি হ্যাচারি তৈরি করে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে প্রজনন মৌসুমে সাগর অথবা নদী থেকে পুরুষ ও স্ত্রী ইলিশ রাখছি। সব ধাপ অতিক্রম করে পোনা নদীতে ছাড়া গেলে, তখন উৎপাদন আরও বাড়বে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ইলিশ রক্ষায় সরকার এ পর্যন্ত যে কটি পদক্ষেপ নিয়েছে, তার প্রতিটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে নেওয়া হয়েছে। আর এর বাস্তবায়নও বেশ কঠোরভাবে করা হয়েছে। এর সুফল পাওয়া গেছে। গবেষণায় ইলিশের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *