অভিমত

‘জয় বাংলা’ : দুই বাংলা, এক স্লোগান

তাপস দাস, কলকাতা :

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস পুনরায় জনগণের সম্মতি নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। এই নির্বাচনে যে দুটি স্লোগান তৃণমূল কংগ্রেসকে মানুষের সম্মতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে একটি ‘খেলা হবে’ এবং অন্যটি ‘জয়বাংলা’ । প্রথম স্লোগানটিকে পশ্চিমবঙ্গে যিনি জনপ্রিয় করে তুলেছেন তিনি হলে দেবাংশু ভট্টাচার্য, যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা শামীম ওসমানের কণ্ঠে বহুবার এই স্লোগান শোনা  গেছে, তবে দেবাংশু যেহেতু খেলা হবে শব্দদ্বয়ের  পিছনে কবিগুরুর একটি কবিতার অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন তাই এ বিষয়ে বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। আমার আলোচনার বিষয় ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি নিয়ে।

‘খেলা হবে’ স্লোগানটি তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টিতে সাহায্য করলেও, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মনোজগত অধিকার করে নিয়েছে তাহলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ঠিক যেইভাবে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙলিদের প্রভাবিত করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে। যদিও সময় এবং প্রেক্ষাপট আলাদা তবে একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, উভয় ক্ষেত্রে কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে স্লোগানটি ।

‘জয় বাংলা’ স্লোগানটির একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে যার সূচনা হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং এক্ষেত্রে এই স্লোগানটি সম্পূর্ণ ওপারের বাঙলির, কারণ শেখ মুজিব খুব নির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন, “এই বাঙলির ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।” ঐতিহাসিকভাবে জয় বাংলার উৎপত্তি সম্বন্ধে জানা যায় যে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন মাদারীপুরের স্কুল শিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এর জন্য জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন তিনি। তার আত্মত্যাগ, তার স্বজাত্যবোধে মুগ্ধ হয়ে পূর্ণচন্দ্র দাস মহাশয়ের কারামুক্তি উপলক্ষে কালিপদ রায়চৌধুরীর অনুরোধে কবি নজরুল রচনা করেন ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ (১৯২২ খ্রি.) কবিতাটি। এই কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তার রচিত ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধেও জয় বাংলা পাওয়া যায়। নিচে ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কাব্য থেকে উদ্ধৃত হল:

“জয় বাঙলা’র পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি অন্তরীণ,

জয় যুগে যুগে আসা সেনাপতি, জয় প্রাণ অন্তহীন।”

‘জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান এবং এরই মধ্যেদিয়ে বাঙালির শাশ্বত স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতিফলন ঘটেছে প্রতিনিয়ত। ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবস (১৭ মার্চ) যৌথভাবে পালনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়নে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর আহুত সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমেদ ও চিশতী হেলালুর রহমান “জয় বাংলা” স্লোগানটি সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেন। তবে ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০-এ ঢাকা শহরের পল্টনের এক জনসভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান তার ভাষণে সর্বপ্রথম “জয় বাংলা” স্লোগানটি উচ্চারণ করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খান প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার পরে এই প্রথম জনসম্মুখে শেখ মুজিব। মঞ্চে উপবিষ্ট বঙ্গবন্ধুর পেছনে দেবদারু পাতায় ছাওয়া ব্যানারে হলুদ গাঁদাফুল দিয়ে লেখা দুটি শব্দ: ‘জয় বাংলা’। খুব ছোট্ট দুটি শব্দ অতি দ্রুত সমাবেশে উপস্থিত জনতার মাঝে ছড়িয়ে যায়। আলোচনা শেষে ছাত্রলীগ ‘জয় বাংলা’ লেখা ওই ব্যানারটি নিয়ে পথসভা বের করে, যা শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। পরদিন সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার পাশাপাশি ‘জয় বাংলা’ ব্যানারটির কথাও উল্লেখ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে প্রথম “জয় বাংলা” স্লোগানটি উচ্চারণ করেন ৭ মার্চ ১৯৭১-এ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভার ভাষণে।

এ প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায় মন্তব্য করেছিলেন, “আমরা কেউ ওপারের মুসলমানদের শিখিয়ে দিইনি যে তোমরা পূর্ব পাকিস্তানের নাম রাখো বাংলাদেশ, তার মুক্তির জন্য সংগ্রামে নামো, তোমাদের ধ্বনি হোক ‘জয়বাংলা’, তোমাদের জাতীয় সংগীত হোক ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, তোমাদের জাতীয় পতাকা থেকে চাঁদ তারা বাদ দাও, তোমাদের জাতীয় ভাষা হোক বাংলা। এ সমস্ত ওদের নিজেদের স্বেচ্ছাকৃত এবং স্বপ্রণোদিত।”

একথা সত্য, রাজনৈতিকভাবে আমরা আলাদা কিন্তু ৫০ বছর পরও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন প্রমাণ করলো ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র এক, কবিগুরুর ভাষায় সে বাংলাদেশ এখন পদ্মাপাড়েই নামাঙ্কিত, গঙ্গা পাড়ে তার অন্য নাম। বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমান আট শতাব্দী ধরে একসঙ্গে বাস করেছে। ধর্ম আলাদা হলেও ভাষা আলাদা ছিল না। সুলতানি আমলে, মোঘল আমলে ও ব্রিটিশ আমলের প্রথম সত্তর আশি বছর সরকারি ভাষা ছিল ফারসি। সে ভাষা হিন্দুরাও শিখত। সেই সূত্রে মুসলমানদের সঙ্গে একপ্রকার মানসিক মিল ছিলো, আজ মানসিক অবচেতনে হয়তো ‘জয় বাংলা’ তাই নির্বাচনী পরিত্রাণ হিসেবে ঐতিহ্য ও পরিচিতি বাঁচানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টিও যে ‘সোনার বাংলার’ কথা বলেছে তা ভুলে গেলে চলবে না যা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা প্রসূত। এক্ষেত্রে আমাদের জানা দরকার স্বাধীনতার পর কলকাতা থেকে সাহিত্যিকদের একটি দল ঢাকায় এসেছিলেন। সেই দলে একজন ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, তিনি শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন “বাংলাদেশের আইডিয়াটা কবে প্রথম আপনার মাথায় এলো?” মুজিব মুচকি হেসে বলেছিলেন সেই ১৯৪৭ সালে।……তারপর তিনি বিমর্ষ হয়ে বললেন, ‘দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎ বসু…তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা।’

তবে আমি জয় বাংলা স্লোগানের ব্যবহারকে শুধুমাত্র একটি নির্বাচনী অস্ত্রের বিপরীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিন্তা, তার অর্থনৈতিক বিস্তারের পাশাপাশি পাশের দেশকে ভাবাচ্ছে সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায় সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎ বসুর দিল্লি থেকে ফিরে আসা হতাশ করলেও, ২০২৪ এ মমতা ব্যানার্জীর হাত ধরে কি জয় বাংলা দিল্লির মসনদ দখল করবে?

তাপস দাস, গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, কলকাতা।

তথ্যসূত্র:

জয় বাংলা -উইকিপিডিয়া

মুনতাসির মামুন, ‘বঙ্গবন্ধু কিভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’, মাওলা ব্রাদার্স , ২০১৩, ঢাকা

‘জয় বাংলা: ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি’, আমীন আল রশীদ, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, বাংলা ট্রিবিউন

অন্নদাশঙ্কর রায় ‘শত বর্ষ পরে’ কফি হাউস, কথা ও কাহিনী, ২০১৭, কলেজ স্ট্রিট

মারুফ রসুল, ‘গণজাগরণ মঞ্চ থেকে বলছি’, আগামী প্রকাশনী, ২০১৩, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *