সম্প্রতি এক ভিডিও বার্তায় সুপ্রিয় পাঠক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি “জন্মভূমিকে কেন ভালোবাসি” শিরোনামে সৃজনশীল লেখা আহ্বান করেছেন ধূমকেতু বাংলা (dailydhumketu.com)-এর সম্পাদক ও প্রকাশক খোকন কুমার রায়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই লেখা পাঠিয়েছেন। তাদের লেখাগুলো পর্যায়ক্রমে ছাপা হচ্ছে।

জন্মভূমিকে কেন ভালোবাসি

দিলীপ গমেজ

“জন্মভূমিকে কেন ভালোবাসি?” তার উত্তরে আমি বলবো, ভালোবাসি বলেই হয়তো ভালোবাসি। ভালোবাসা হল মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি। আদিকাল থেকে এখনো অব্দি ভালোবাসার যে রূপ রঙ রসের অনুভবতা আমরা দেখে এসেছি তারই ধারাবাহিকতায় দাঁড়িয়ে আজ যদি আপনাকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করি… জন্মভূমিকে আমরা কেন ভালোবাসি? এর উত্তরে আপনারা অনেকেই হয়তো বলবেন ভালোলাগে তাই ভালোবাসি। অথবা ভালোবাসতে হয় বলেই ভালোবাসি, নয়তো ভালোবাসতে ইচ্ছে জাগে তাই ভালোবাসি।

এবার আসি আসল কথায়,

ঐ যে শুরুতেই বলেছিলাম আদিকাল থেকে এখনো অব্দি ভালোবাসার যে রূপ রঙ রসের অনুভবতা আমরা দেখে এসেছি তার বেশির ভাগই হল, একজন মানুষ হিসেবে অপর একজন মানুষের প্রতি ভালোবাসা, আর মানবিক কারণে পশু পাখী জীবের প্রতি ভালোবাসা। ভালোবাসার ক্ষুদ্র প্রকারভেদে অনেক ধরনের ভালোবাসাই আমরা দেখেছি। তবে সেটি মূল ভালোবাসারই একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, যেমন একজন প্রেমিক প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা, বাবা, মা, ভাই বোনদের প্রতি ভালোবাসা, এক সাথে থাকতে থাকতে পোষা পশু-পাখীদের প্রতি ভালোবাসা। মূল কথা হল সামাজিক বা পারিবারিক পরিমণ্ডলের দিক থেকে মূলত ভালোবাসা বলতে আমরা এই বুঝি। এ ছাড়াও আরও অনেক কিছুকেই আমরা ভালোবাসি।

কিন্তু যদি বলি “জন্মভূমিকে কেন ভালোবাসি?” এবারো অনেকেই বলবেন জন্মভূমি মানে দেশ আর দেশ মানে এর মানুষ, জনপদ, মাটি, নদী, নালা, খাল বিল, প্রান্তর, আকাশ, বাতাস, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র এবং সীমানা। তাই অনেক কিছুর মতো জন্মভূমিকেও আমরা ভালোবাসি।

আমিও এখানে আপনাদের সাথে একমত পোষণ করছি এবং আমার একান্ত নিজের কিছু আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করছি।

মা, মাটি ও মানুষ এ তিনটি জিনিস মানুষের কাছে মহা মূল্যবান। মানুষের এ দুর্নিবার আকর্ষণ বা ভালোবাসা, অথবা ভালো লাগার যে গভীর আবেগ-অনুভূতি ও মমত্ববোধ এই উপলব্ধিই মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় এক গভীর প্রেমের। সেই প্রেমের গভীরতা যখন আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এক সময় এতে জন্ম নেয় এক স্বপ্নিল মায়ার বন্ধনের। একজন মানুষ যখন প্রেম-ভালোবাসার ঊর্ধ্বে চলে যায় তখন মায়ার অনুভবে সুতোই টান পড়ে। আবার যখন একজন মানুষ প্রেম-ভালোবাসার টানে কোনো জিনিস অথবা একটা জায়গাকে নিজের আপন ভাবতে শুরু করে তখনো জন্ম নেয় সেই জিনিস বা জায়গাটির প্রতি এক চরম ভালোবাসার প্রেম।

দিলীপ গমেজ

বিস্তারিতভাবে এখানে কিছু চাক্ষুষ উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আপনাদের একটু বোঝাবার চেষ্টা করছি।

ধরা যাক আমরা যখন একটি নির্দিষ্ট স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করি তখন আমাদের চারপাশে বসবাসরত সমস্ত মানুষ, পশু-পাখী, গাছ-পালা, স্কুল, মাঠ, ধানি জমি, পুকুর, খাল-নদী, আকাশ ইত্যাদির মধ্যে এক ধরনের মিতালী হয়ে যায় আর এরই নাম হল মায়া। আবার আমরা যখন কোনো কারণে আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যাই তখন প্রতিনিয়ত মনের অজান্তেই মনে পড়ে সেই পূর্বের স্থানটি নিজের মনের কল্পনায়। যেন এক ধরনের মায়ার টান। ঠিক তেমনিভাবে আমরা যখন কোনো কারণে অথবা জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে অথবা কর্তব্যের খাতিরে বিদেশে বসবাস করতে হয়, তখনো মনের অজান্তেই নিজের আপন জন্মস্থানটিকে আমরা তুলনা করি নতুন জায়গাটির সাথে, ফলে এক নিমেষেই মন ছুটে যায় সেই চিরচেনা বলয়ে। অনুভব করতে থাকি কতোটা প্রেম, কতোটা ভালোবাসার মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে ছিলাম সেই জগতটিতে।

এখানে উল্লেখ্য যে, শুনেছি, আমাদের মহানবী (সাঃ) তাঁর জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় যাওয়ার পথে অশ্রুসজল নয়নে বারবার ফিরে তাকাচ্ছিলেন তাঁর চিরচেনা জন্মভূমির দিকে। কারণ তিনি তাঁর নিজের জন্মভূমিটিকে ভালোবাসতেন আর অনুভব করতেন নিজের আপন জগতের বলয়ে। এই যে টান, এ যেন মায়ের নাড়ির টানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

মা যেমন তাঁর নিজ সন্তানদের স্নেহ-মায়া-মমতা-ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখেন, ঠিক তেমনি করে নিজের দেশ বা জন্মভূমিও তার আলো-ছায়া, বাতাস ও সম্পদ দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, শুধু রাখে বললে ভুল হবে একেবারে নিঃস্বার্থভাবেই রাখে।

তাই দেশ অর্থাৎ জন্মভূমিকে জননীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

আবার অন্যভাবে যদি আমরা দেখি জন্মভূমিকে ভালোবাসলে আমাদের কী কী উপকার সাধিত হতে পারে? সেই ক্ষেত্রে আমরা জানি একটি দেশের মানুষের মধ্যে আলাদা আলাদা মতভেদ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পারস্পারিক বিরোধ, সংঘর্ষ-সহিংসতা বা প্রতিহিংসা থাকতেই পারে কিন্তু যখন নিজের দেশের সাথে অন্য কোনো দেশের সমস্যা কিংবা যুদ্ধ শুরু হয় তখন নিজের জন্মভূমি রক্ষায় সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে সবাই একত্রে মরিয়া হয়ে যাই। এতে করেই বোঝা যায় নিজের জন্মভূমিটিকে আমরা কতোটা ভালোবাসি। উদাহরণ স্বরূপ আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলতে পারি।

অতএব, পরিশেষে এসে একটি কথা আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবো না- জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা মানুষকে মমত্ববোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করে পারস্পরিক সম্পর্ক পূরণে। আর যেহেতু একমাত্র জন্মধারিণী মা এবং নিজের জন্মভূমিই পারে আমাদেরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা দিতে, সেহেতু উপলব্ধি জ্ঞানই আমাদেরকে শিখিয়েছে মাতৃভূমি বা জন্মভূমিকে ভালোবাসতে।

আর এই কারণেই সবার মতো আমিও বলবো আমি আমার জন্মভূমিকেও খুব ভালোবাসি।

দিলীপ গমেজ: পেশা- চাকুরী, শখ: লেখালেখি, অভিনয়, গান, আবৃত্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *