লেখালেখি

ছোট গল্প ‘টই টই-২’

প্রকাশ ঝাঁ :

বেশিদিন হয়নি জ্বর থেকে উঠেছে ছেলেটা। ওর মা তো রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। হুজুরের কাছ থেকে তেল পড়া, পানি পড়া এমনকি মানৎ পর্যন্ত করতে ছাড়েনি। এ যাত্রায় যেন ছেলেটার কিছু না হয়! নীলু, দুই সন্তানের জননী। খুব কষ্টের সংসার ওদের। বড় ছেলে ক্লাস সেভেনে পড়ে ওদের গ্রামের একটা নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে। নীলু এর-ওর মুখে শুনেছে তার বড় ছেলের নাকি মেধা ভালো । সেদিন তো শিমুল রাতে ভাত খেতে খেতে বলল অলির স্কুলের অংকের স্যার নাকি বলেছে, “শিমুল, তোমাদের অলি তো একবারেই সব বুঝতে পারে দুইবার বোঝাতে হয় না”। কথাগুলো শুনে কোথায় যেন একটা নির্মল শান্তি অনুভব করেছিলেন নীলু! আবার সেই বাস্তবতায় ফিরে আসা এবং দীর্ঘশ্বাস ও আত্মসমর্পণ, “এইলা চিন্তা করে আর কি হবে; সংসার চলেনা এইত্তি! ছুয়াডাক কি আর পড়ভা পারিম!!”

শিমুল, বয়স ৩৪/৩৬। একটি সি-গ্রেড কীটনাশক কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। বেতন আর ইনসেন্টিভ মিলে যা পায় তাতে কোনো মতে তিরিশ দিনের নিত্যপণ্য হয়; হয়না। শিমুলের দুই ছেলে মোঃ অলিউর রহমান, মোহাম্মদ জলিল (জলি)। শিমুলের বিয়ে হয়েছে ১৪/১৫ বছর, অলি পড়ে ক্লাস সেভেনে, জলির বয়স তিন বছর। বাবার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভিটে বাড়ি এবং স্থাবর সম্পত্তি বলতে এইটুকুই। যাকে বলে হাতে-পেটে। নীলু খুব ভালো মানুষ এটা শিমুলের ধারণা। ধারণা বলার কারণ, কখনোই শিমুলের প্রণয় সমেত নীলুফাকে উপলব্ধির সুযোগ হয়নি, যতুটুকু হয়েছে প্রয়োজনের জন্যই, আর জীবনের বাস্তুগত পরিস্থিতিকে সমন্বয়ের চাপে।

শিমুল চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে, ছোট্ট অলির জন্য এক কেজি কমলালেবু কেনার কথা ভাবছে। কারণ, ডাক্তার বলেছে অলিকে বেশি করে ভিটামিন সি খাওয়াতে। আরো বলেছে সিভিট বা অন্য কিছু না, কমলালেবুটাই সরাসরি খাওয়াতে। পকেটে টাকা মাত্র নয়শত পঞ্চাশ। কালকে আবার সাপ্তাহিক কিস্তি আছে। রাত বাজে এগারোটা, এখন কি আর কোনো দোকানদার কালেকশন (এই ক্ষেত্রে বকেয়া আদায়) দিবে? তারপরেও শিমুল কমলালেবু কিনলো, ভালো মানেরটার দামও একটু বেশি। কিনেই বাইসাইকেলে চড়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো শিমুল।

সাইকেলের প্যাডল এর সাথে তার ভাবনাও সমানতালে ঘূর্ণায়মান! কাল সকালেই এনজিও’র সাহেব আসবে। কিস্তি এগারো’শ টাকা, কোথা থেকে জোগাড় করবে! হঠাৎ সাইকেল থামিয়ে মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে টাকা বের করে গুনে দেখল, সাতশ টাকা, আরও দরকার…! খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো শিমুল। শিমুলের কোনো ঋণ ছিলোনা। কিন্তু গতবার টার্কি প্রোজেক্টে (এমএলএমপদ্ধতিতে) বিনিয়োগ করতে গিয়ে এই বাড়তি বোঝাটা চেপেছে তার ঘাড়ে।

বছর দুই আগে নীলু ওর বাবার কাছ থেকে খুব অনুনয় করে একটা বাছুর এনেছিল। অনুনয় করার কারণ, নীলুফার বাপও দিনমজুরি করে। কোনো মতে আয়ুর অবশিষ্ট দিন গুনছে। কিন্তু, নীলু একমাত্র মেয়ে হওয়ায় ওর বাবার কাছে এটা ছিল প্রাণের দাবি যে, একটা গরু কিনে দিতে হবে, না হলে নীলুর ভাষা এইরকম “তোর নাতিলাক তেহিলে তি কি দিলো?”।

অবশেষে যেদিন নীলু বাপের বাড়ি থেকে একটা গরু নিয়ে এলো, সেদিন থেকেই নীলুকে শিমুলের খুব ভালো মানুষ হিসেবেই মনে হয়। টানও (ভালোবাসা) বেড়েছে নীলুর প্রতি। টার্কি প্রজেক্টে ঐ গরুটাও বিক্রি করেছে শিমুল। গরু বিক্রির পঞ্চাশ হাজার আর আশা সমিতির ঋণ পঞ্চাশ হাজার এই মিলে এক লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছে। চুক্তি ছিল নব্বই দিনে আরও পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা লাভ সমেত মোট এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা কোম্পানি ওকে দিবে। এই লাভের টাকা নিয়ে অনেক পরিকল্পনাও এঁটেছিল শিমুল আর নীলু। বিনিয়োগের দুই মাস যেতে না যেতেই কোম্পানী হাওয়া। না হলে কি আর এক কেজি কমলালেবু কিনতে এতো ভাবতে হয় শিমুলকে!

চাল্লু প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক; চাল্লুর বউ স্বাস্থ্যবিভাগে চাকুরি করে। চাল্লুর এই লোভাতুর যোজন নিয়ে উৎকণ্ঠার শেষ নেই লাল্লুর। কারণ, লাল্লু, চাল্লুর ছোটবেলার বন্ধু। আর লাল্লু এখনো বিয়ে করেনি। লাল্লুও প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রতিদিন স্কুল শেষ করে এসে ওজু করে ক্বাজা নামাজ পড়ে যখন চিৎ হয়ে শরীরটা একটু এলিয়ে দেয় নরম বিছানায়, তখন ছাদ বরাবর অদৃশ্য স্ক্রিনে ভেসে ওঠে চাল্লুদের উচ্চতা। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ আয় আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাপ্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দিয়ে জ্যামিতিক হারে তড়তড়িয়ে কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে চাল্লু। কি বিশাল দূরত্ব!

লক্ষণীয় বিষয় পাঠকের জন্য, দৃষ্টিশক্তি কিন্তু ছাদ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। লাল্লু কিন্তু শুধু ভাবছেই না, সাথে পরিকল্পনাও করছে। তাকেও নিশ্চয়ই একটা সরকারী চাকরিজীবী মেয়েকে বিয়ে করতে হবে; পৈত্রিক প্রাপ্তি আর নিজের ও বউয়ের আয় সব মিলিয়ে চাল্লুদের সমান সমান না হলেও পিছিয়ে থাকবেনা মোটেই। যেই ভাবা সেই কাজ আর সেই কার্য-সম্পাদনের ফলাফল থাকছে আরেক পর্বে…।

আসল কথা হলো: মাপামাপি/পরিমাপ

সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা দ্রব্যের ওজন পরিমাপের জন্য প্রথম এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এই পরিমাপ পদ্ধতির আবিষ্কার সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক অবদান রেখে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন দ্রব্য ওজনের জন্য নানা মাপের ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির বাটখারা ব্যবহার করতো। দাগ কাটা স্কেল দিয়ে দৈর্ঘ্য মাপার পদ্ধতিও তারাই ব্যবহার করে। এখন প্রশ্ন হলো এই পরিমাপের প্রয়োজনীয়তা কোথায়?

যতদূর জানা যায়, দৈনন্দিন কাজকর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে প্রাচীনকাল থেকেই পরিমাপের প্রচলন ছিল। এই পরিমাপের জন্য বিভিন্ন রাশির স্থানীয় বা এলাকা ভিত্তিক বহু একক প্রচলিত ছিল। যেমন: কিছুকাল পূর্বেও আমাদের দেশে ভরের একক হিসেবে মণ, সের ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। আবার দূরত্ব নির্দেশের একক হিসেবে মাইল কিংবা দৈর্ঘের জন্য গজ, ফুট, ইঞ্চি ইত্যাদি এখনো প্রচলিত আছে। বৈজ্ঞানিক তথ্যের আদান-প্রদান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য সারা বিশ্বে পরিমাপের একই রকম আদর্শের প্রয়োজন পড়ে। এ থেকে ১৯৬০ সালে গোটা বিশ্বে বিভিন্ন রাশির একই রকম একক চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। এককের এ পদ্ধতিকে বলা হয় আন্তর্জাতিক পদ্ধতি বা সংক্ষেপে এসআই (SI)।

সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক পদ্ধতি চালুর পূর্বে বৈজ্ঞানিক হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রে এককের তিনটি পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, যথাঃ সিজিএস (CGS), এমকে এস (MKS), এফপিএস (FPS)। সব ঠিকই আছে। কিন্তু, সাল্লু কিংবা লাল্লুর এই দাঁড়িপাল্লাবিহীন এবং অপ্রয়োজনীয় পরিমাপে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে জীবনের স্বাদকে বিষাদে পরিণত করার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? বরং নিজেকে জেনে; আহরিত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার সঠিক প্রয়োগ করাই সর্বোত্তম জীবন বলে মনে হয়। এটাই জীবন, জীবনের উদ্দেশ্য। বাকিসব এক মিষ্টি বন্ধুর ভাষায় ‘হুদাই’।

কারণ, এই পরিমাপের প্রতিক্রিয়া আমাদের সমাজে প্রকট এবং নির্মমভাবে আঘাত হানে। এই পরিমাপের ওজন ব্যবস্থায় নিজেকে সবসময় ভারী প্রদর্শনের জন্য হেনো কোনো অনৈতিক কাজ নেই যা মানুষ করছেনা। মনুষ্যত্ববোধ যেন এখন টার্কি কোম্পানির মতো হাওয়া। পক্ষান্তরে পরিমাপের অন্তমিলে পরবর্তী প্রজন্মও জীনগতভাবে একই ধারা বহন করছে; সমাজ হচ্ছে নষ্ট । সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক কীট, পরিবার থেকে পরিবারে। যার দোলায় শিমুলের মত পরিবারও অতি দ্রুত কিছু পেয়ে পরিমাপে একটু এগিয়ে থাকার জন্য নিজের সর্বস্ব সঁপে দেয় অমানুষদের পেতে থাকা বিষাক্ত হাতে। ‘টই টই’ না হয়ে সংশোধন হওয়া জরুরী। মূল থেকে অর্থাৎ নিজ পরিবার থেকে। সময় আসছে। যাচ্ছে না।।

রাজাগাঁও, ঠাকুরগাঁও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *