ডেস্ক রিপোর্ট, ধূমকেতু ডটকম: লাজিনা বিবির বয়স যখন মাত্র ২২ বছর, তখন তাঁর স্বামী মারা যান। সেটা ১৯৮২ সালের কথা। তখন তাঁর কোলে তিন সন্তান—দুই মেয়ে, এক ছেলে। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে কঠিন এক সংগ্রাম শুরু হয় লাজিনার। নিজেদের কিছু জমি চাষের পাশাপাশি অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন, বড় করেছেন তিন সন্তানকে।
বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ধুলাতইর গ্রামের বাসিন্দা লাজিনা অবশেষে সুদিনের দেখা পেয়েছেন। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে সরকারি স্কুলের শিক্ষক হওয়ায় সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা।
লাজিনা বলেন, ‘একসময় আর্থিক সংকটের কারণে বিধবা ভাতার কার্ড নিয়েছিলাম। ওই কার্ড আমার আর প্রয়োজন নেই। তাই ছেলেকে বলেছি, বাবা, কার্ড সমাজসেবা অফিসে ফিরিয়ে দাও। আরেকজন বিধবা আমার এই কার্ড পেয়ে উপকৃত হবে।’
মায়ের আদেশ অনুযায়ী গত ৭ জুন উপজেলা সমাজসেবা অফিসে গিয়ে বিধবা ভাতার কার্ড ফেরত দিয়েছেন ছেলে মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘আমার মা আমাদের সকলের জন্য গর্ব। তিনি আমাদের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার কোনো তুলনা করা যায় না। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে আমি একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছি, সমাজে পেয়েছি শিক্ষকের মর্যাদা।’
১৯৮২ সালে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে তিন সন্তানকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন লাজিনা। অভাব আর দারিদ্র্য চেপে বসলেও তিন সন্তান নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। স্বামীর পাওয়া মাত্র ১০ শতক জমিতে নিজেই চাষ শুরু করেন, পাশাপাশি অন্যের জমিতে কাজ করতেন তিনি। এভাবেই সন্তানদের মুখে আহারের ব্যবস্থা করতেন লাজিনা, পাশাপাশি জোগান দিতেন সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ। সংসার জীবনে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হন এই নারী। এর মাঝে বড় হয়ে ওঠে তাঁর দুই মেয়ে। অনেক কষ্টে জমানো টাকা আর কিছু মানুষের সহযোগিতায় ১৯৯৬ সালে বড় মেয়ে হাফিজা এবং ১৯৯৮ সালে ছোট মেয়ে মাহফুজার বিয়ে দেন।
বিয়ের পর চরম আর্থিক সংকটে পড়েন লাজিনা বিবি। একমাত্র ছেলে মামুনুর রশিদকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার কঠিন প্রত্যয় চেপে বসে তাঁর। ছেলেকে যোগ্য মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক কষ্টে লেখাপড়ার খরচ জোগান। শেষে নিরুপায় হয়ে উপজেলার ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদে বিধবা ভাতার আবেদন করেন। ১৯৯৮ সালে তাঁর নামে উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে চালু হয় বিধবা ভাতা। তখন প্রতি মাসে একটি কার্ডের বিপরীতে দেওয়া হতো মাত্র ১০০ টাকা।
মায়ের অদম্য সাহস আর সহযোগিতায় জয়পুরহাটের আক্কেলপুর সরকারি মজিবুর রহমান ডিগ্রি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন মামুনুর রশিদ। ২০১৪ সালে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক পদের জন্য পরীক্ষা দেন মামুন। লিখিত ও মৌখিক উভয় পদে উত্তীর্ণ হন তিনি। কিন্তু প্যানেল পদ্ধতির কারণে পিছিয়ে যায় নিয়োগ।
লাজিনা বিবি বলেন, চাকরি না হওয়ায় ছেলে ও তিনি—দুজনেই হতাশ হয়ে পড়েন। পরে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকাপয়সা ধার করে ছেলেকে মালয়েশিয়ায় পাঠান। সেখানে দুই বছর চাকরির পর সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আসে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্যানেল থেকে নিয়োগ দেওয়া শুরু করে সরকার। এতে মামুনের চাকরি হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়নের সরকারি চকসোনার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা শরিফ উদ্দীন বলেন, বিধবা ভাতার কার্ড ফেরত দিয়ে লাজিনা বিবি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর এই কাজ অনেকের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে সংগ্রামী লাজিনা বিবিকে সম্মাননা দেওয়া হবে। সূত্র: প্রথম আলো।