নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোকে আবাসন সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে সরকারি কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে ৬৬ হাজার ১৮৯টি বাড়ি বিতরণ উদ্বোধন করেছেন।
বিশ্বে এই প্রথমবারের মতো ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোর মাঝে একইসঙ্গে এই বিপুল সংখ্যক গৃহ হস্তান্তর করা হলো। সরকার গৃহহীন মানুষের সমস্যা মোকাবেলায় কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এটি তার ইঙ্গিত দেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি এই গৃহ হস্তান্তর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সরকার গৃহহীন লোকদের জন্য ১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৬ হাজার ১৮৯টি গৃহ নির্মাণ করেছে। আগামী মাসে গৃহহীনদের মাঝে আরো প্রায় ১ লাখ গৃহ বিতরণ করা হবে। পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অধীনস্থ আশ্রয়ন প্রকল্প মুজিব বর্ষ উদযাপনকালে ২১টি জেলার ৩৬টি উপজেলায় ৪৪টি প্রকল্পের অধীনে ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণ করে ৩,৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করছে।
সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য এই ব্যারাক নির্মাণ করছে।
আশ্রয়ন প্রকল্প ২০২০ সালে ৮,৮৫,৬২২টি পরিবারের তালিকা তৈরি করেছে। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার এবং ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি পরিবারের ১-১০ শতাংশ ভূমি রয়েছে। তবে, তাদের বসবাসের বাড়ি নেই।
তিনি আরো জানান, আশ্রায়ন প্রকল্প ১৯৯৭ সালে থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২০ হাজার ৫৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসিত করেছে। এ ছাড়াও আশ্রয়ন-২ প্রকল্প ৪,৮৪০.২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে (জুলাই ২০১০ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত) ২ লাখ ৫০ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার ও ছিন্নমূল পরিবারকে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে ১ লাখ ৯২ হাজার ২২৭টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ইতোমধ্যে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ৪৮,৫০০ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭৭টি পরিবারের প্রত্যেকের ১ থেকে ১০ শতাংশ ভূমি রয়েছে। কিন্তু তাদের বাড়ি করার সক্ষমতা নেই।
এছাড়াও, প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু ৬ শত পরিবারের জন্য কক্সবাজারের খুরুশকুলে ২০টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করেছে। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ডিটেইল্ড প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) এর মাধ্যমে আরো ১১৯টি বহুতল ভবন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করছে।
‘ছিলাম ভূমিহীন, এখন জমি ও ঘরের মালিক’
ধরলা নদীর ভাঙনে জামিলা বেগমের ভিটা গেছে, ঘরও গেছে। জমি কিনে বাড়ি করার মতো আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না। ৫ বছর ধরে থাকছেন অন্যের আশ্রয়ে। সেই জামিলার দুঃখ ঘুচে গেছে আজ। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তিনি একটি আধা পাকা ঘর পেয়েছেন।
জামিলার বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগভাঙ্গা ইউনিয়নে। নতুন বরাদ্দ পাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জামিলা বলেন, ‘ছিলাম ভূমিহীন, এখন জমি ও ঘরের মালিক। খুব খুশি লাগছে।’ ১৫ জানুয়ারি ঘরের ২ শতাংশ জমিও তাঁর নামে লিখে (বন্দোবস্ত) দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
জামিলা বেগমের মতো সারা দেশে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে আধা পাকা ঘর দিচ্ছে সরকার। জামিলা বেগমের পাশের ঘরে ছিলেন দেলো বেগম। তার বয়স ৮০ বছরের বেশি। তার জীবনের গল্পটা ভিন্ন। তার স্বামীর জায়গা–জমি ছিল না। স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনি ছিলেন বাবার দেওয়া জমিতে। কিন্তু সেই জমি প্রতারণা করে লিখে নেন এক প্রতিবেশী।
৪৫ বছর আগের সেই ঘটনা আজও দেলো বেগমকে পীড়া দেয়। বললেন, বাড়ি থেকে বের
করে দেওয়ার ঘটনা ভুলতে পারি না। তিনি বলেন, ‘শ্যাষ বয়সে আইসা জমি ও ঘর পাব,
কোনো দিন ভাবতে পারি নাই। শেখ হাসিনা ঘর দিছে, আল্লায় তাক শান্তি দিক।’
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগভাঙ্গার এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমি ও ঘর পেয়েছে ১৬টি পরিবার।
গতকাল শুক্রবার সকালে সেখানে গিয়ে আরও অনেকের অজানা গল্পগুলো জানা গেল। যেমন ভূমিহীন পরিচয়টি খুব কষ্ট দিত ষাটোর্ধ্ব আবদুল হামিদকে। তিনি দিনমজুরি করেন। অভাবের সংসারে দিন এনে দিন খেতে চলে যায়। তারপরও একবার কষ্ট করে ২ শতাংশ জমি কেনার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের অসুখের পেছনে চিকিৎসায় তা আর হয়নি। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আবদুল হামিদ বললেন, গ্রামে জমি না থাকলে কেউ মূল্য দেয় না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। সেই কষ্ট আর থাকবে না। বললেন, ‘সরকার হামাক ২ শতক জমি কিনি দিচে, হামরা খুউব খুশি হইছি।’
নতুন বরাদ্দ পাওয়া ঘরের দেয়ালে নিজের ও স্বামীর নাম আলপনায় এঁকেছেন মিষ্টি বেগম। ৭ বছর আগে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। স্বামীর ভিটেবাড়ি না থাকায় তাকে থাকতে হয়েছে বাবার বাড়িতে। আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে ঘর পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নীলুফা ইয়াসমিন বলেন, এই এলাকাটিতে ভূমিহীন ও নদীভাঙনকবলিত মানুষের সংখ্যা বেশি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এসব পরিবার ছিন্নমূল জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ি ইউনিয়নের বানিয়ারকুটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে শুক্রবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, বন্যার সময় করা আশ্রয়ণকেন্দ্র ও আশ্রয়ণ প্রকল্প পাশাপাশি। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে ৪০টি ঘর। আশ্রয় পাবে ৪০টি পরিবার।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল মোতালেব বললেন, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে দুধকুমার নদের দূরত্ব আধা কিলোমিটার। এলাকাটি বন্যাকবলিত। দুধকুমার নদের ভাঙনে ভিটাহারা কিছু পরিবার ঘর পেয়েছে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম বলেন, সারা দেশে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলায় ১ হাজার ৫৪৯টি পরিবার ২ শতাংশ করে জমি ও একটি ঘরে আধা পাকা ঘর পাবে। বানিয়ার কুটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের পশ্চিম পাশে ঘর পেয়েছেন আনোয়ার হোসেন। তার ঘরে ঢুকে দেখা গেল, একটি রুমের দরজা নতুন পর্দা দিয়ে সাজানো। আনোয়ারের স্ত্রী রাশেদা বেগম বলেন, নতুন ঘর পাওয়ায় তিনি খুশিতে পর্দা কিনে এনেছেন।