অভিমত

ছিটমহল বিনিময় এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

 অরুণ কুমার গোস্বামী :                           

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের বয়স আগামীকাল ৩১ জুলাই ছয় বছরে উপনীত হচ্ছে। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহল বিনিময় হয়েছিল। দু’টি প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের সীমান্তের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় উভয় দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর দৈর্ঘ্যরে কারণে এর ব্যবস্থাপনা খুবই কঠিন। উভয় দেশের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত, যা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম স্থল সীমান্ত।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে বাংলাদেশ ও ভারত একটি দেশ ছিল। দেশভাগের ফলে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি আলাদা দেশ গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ভাগের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ হয় (১৯০৫ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গ), বাংলা দুইভাগে বিভক্ত হয়। পশ্চিম বাংলা ভারতের সাথে যুক্ত হয় এবং পূর্ব অংশ পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান নামে যুক্ত হয়। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ও ভারতের সহযোগিতায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভারতের যেসব রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত আছে সেগুলো হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, মিজোরাম, আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়।  অপর দিকে, ময়মনসিংহ (২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি গঠিত), রংপুর, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম এই ৬টি বিভাগ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবস্থিত। ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এবং বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে এবং গাঙ্গেয় বদ্বীপকে ভাগ করার সাথে সাথে অনেক নদ-নদী দুই দেশের মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে গিয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো খুবই ঘনবসতিপূর্ণ। কিছু কিছু স্থানে সীমান্ত রেখার গ্রামগুলোকে এবং এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘর-বাড়ী দালান-কোঠার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। ১৯৪৭ সালের বিভক্তির পর থেকে সুদীর্ঘকাল ব্যাপী চলে আসা সীমান্ত সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ২০১৫ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি (এলবিএ) এবং দুই দেশের ছিটমহল ও অপদখলীয় এলাকা বিনিময়। এতদ্সত্ত্বেও প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে, এই চুক্তি এবং ছিটমহল ও অপদখলীয় এলাকা বিনিময়, দুই দেশের অমীমাংসিত সীমান্ত-সম্পর্কিত ইস্যুগুলো মীমাংসা করতে  এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে কতটুকু অবদান রাখতে পারছে? এই প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

বিশ্বের ছিটমহলগুলোর বেশীরভাগ বাংলাদেশ-ভারতের স্থলসীমান্তের ছোট একটি সেকশনে, কুচবিহার দেশীয় রাজ্যে (যা বর্তমানে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কুচবিহার জেলা) অবস্থিত। বিনিময়ের আগে, সমগ্র বিশ্বে প্রায় ২২৩টি ছিটমহল, ৩২টি কাউন্টার ছিটমহল এবং ১টি কাউন্টার কাউন্টার ছিটমহল ছিল। এ ধরনের ছিটমহল পশ্চিম ইউরোপ, এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত বার্লি ছিটমহল, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, এবং এশিয়া। এছাড়া মরক্কো, স্প্যানিশ ছিটমহল সিউটা ও মেলিল্লা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে আফ্রিকার একমাত্র সীমান্ত।  ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলের শুরুটা হয়েছিল ১৮ শতকের যুদ্ধ এবং বাংলা ও কুচবিহারের শাসকদের মধ্যে শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে।

প্রাচীন ভারতে, উত্তর বঙ্গ ছিল বাংলার অবশিষ্ট অঞ্চলের প্রবেশদ্বার, এবং হিন্দু, মুসলিম এবং বৌদ্ধ রাজত্বের ফ্রন্টিয়ার অঞ্চল।

স্থানীয়ভাবে কিংবদন্তী আছে যে, ছিটমহলগুলোর উৎপত্তি হয়েছে কুচবিহারের মহারাজা এবং মুঘল সেনাপতির মধ্যে দাবা খেলার বাজি ধরা থেকে। দাবা খেলায় কয়েকটি গ্রাম বাজি ধরা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, এই গ্রামগুলো ১৭১১-১৩ সালের মধ্যে কুচবিহারের মহারাজা এবং মুঘল সম্রাটের মধ্যে কয়েকটি চুক্তির ফল। কুচবিহারের বিস্তৃত এলাকা জয় করার পর মুঘলেরা কুচবিহারের কয়েকজন সর্দারকে করায়ত্ব করতে পারছিল না। এই সর্দারেরা এমনসব জায়গায় ছিল যেসব জায়গা ছিল কুচবিহারের অংশ কিন্তু এগুলো ছিল মুঘল ভূখন্ড দিয়ে ঘেরাও করা। একই সাথে, কয়েকজন মুঘল সেনা কুচবিহারের মধ্যে কয়েকটি এস্টেট নিয়ন্ত্রণ করত। ট্যাক্স সংগ্রহ এবং স্থানীয়দের শাসন করা সবই এই মুঘল সেনারা করত। এইসব জেলা মুঘলদের ছিটমহল হয়ে যায়। ছিটমহল সৃষ্টি সেখানকার কুচবিহারের লোকদের দৈনন্দিন জীবনে খুব স্বল্প প্রভাব ফেলেছিল, কারণ কুচবিহার ছিল মুঘলদের করদ রাজ্য। ৩০০ বছরেরও বেশী কাল যাবত, সার্বভৌমত্বের আনুক্রমিক পরিবর্তনের ফলে মুঘলদের পরে ব্রিটিশ, এবং ব্রিটিশের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ১৯৪৭ সালে ভারত, পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পরও ছিটমহলগুলো অব্যাহত রয়ে যায়।

সীমান্ত নির্দিষ্টকরণ প্রচেষ্টা:

ব্রিটিশ শাসনের অবসানের অব্যবহিত পূর্বে ভবিষ্যত পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ দু’টিকে ভাগ করার জন্য ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ‘বাউন্ডারি কমিশন’ নামে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিলেন। ব্রিটিশ আইনজীবী ব্যারিস্টার সিরিল র‌্যাডক্লিফ ছিলেন এর প্রধান এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস থেকে দুইজন করে (বাংলার জন্য দুইজন এবং পাঞ্জাবের জন্য দুইজন) মোট চার জন এবং  নিখিল ভারত মুসলিম লীগ থেকে দুইজন করে (বাংলার জন্য দুইজন এবং পাঞ্জাবের জন্য দুইজন) মোট চারজন সদস্য নিয়ে বাউন্ডারি কমিশন দু’টি গঠিত হয়েছিল।  এভাবে বাংলার জন্য র‌্যাডক্লিফকে প্রধান করে এবং জাস্টিস সি.সি. বিশ্বাস, জাস্টিস বি.কে.মুখার্জি, জাস্টিস আবু সালেহ মোহাম্মদ আকরাম এবং জাস্টিস এস.এ. রহমান-কে নিয়ে গঠিত হয়েছিল মোট পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশন। একইভাবে পাঞ্জাবের জন্য একই র‌্যাডক্লিফকে প্রধান এবং জাস্টিস মেহের চাঁদ মহাজন, জাস্টিস তেজা সিং, জাস্টিস দীন মোহাম্মদ এবং জাস্টিস মুহাম্মদ মুনীর মোট পাঁচ সদস্যের পাঞ্জাব বাউন্ডারি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। জনপ্রিয়ভাবে এই কমিশন র‌্যাডক্লিফ কমিশন নামে পরিচিত।

একজন আইনজীবী হিসাবে র‌্যাডক্লিফ তাঁর পেশাগত জীবনে  কখনো ব্রিটিশ ভারত  সফর করেননি এবং এমনকি তিনি এই উপমহাদেশ সম্পর্কে কোন কিছুই লেখেননি। বাউন্ডারি কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পাবার পর ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই র‌্যাডক্লিফ প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে পদার্পণ করেন। ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত নির্ধারণের জন্য র‌্যাডক্লিফ সময় পেয়েছিলেন মাত্র পাঁচ সপ্তাহ। বাউন্ডারি কমিশনের সকল কমিশনাররাই ছিলেন আইনজ্ঞ, তবে এই কাজের জন্য অপরিহার্য বিশেষায়িত জ্ঞান এঁদের কারোই ছিল না। সীমানা নির্ধারণের জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি ও তথ্য সরবরাহের মত কোন বিশেষজ্ঞও তাঁদের ছিল না। এছাড়া জরীপ করা এবং আঞ্চলিক তথ্য সংগ্রহের মত কোন সময়ও তাঁদের ছিল না। বিলম্ব এড়ানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে জাতিসংঘের মত কোন এক্সপার্ট ও উপদেষ্টাও বাউন্ডারি নির্ধারণের সময় নেয়া হয় নাই।  ব্রিটেনের নতুন শ্রমিক দলীয় সরকার ‘যুদ্ধকালীন দেনায় নিমজ্জিত ছিল, খুব সাদামাটাভাবে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল সাম্রাজ্য সামলাতে পারছিল না।’

এসময় একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও তার পরে নেতাজী সুভাষ বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজের ভীতি, অপরদিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ইংরেজ ঘনিষ্ঠতা। ফলে, শেষ পর্যন্ত এই দুই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভারতীয় উপমহাদেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার। ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে, ভাগ করে দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত র‌্যাডক্লিফ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোন পরিবারগুলো ভারতের অংশে থাকবে আর কারা পাকিস্তানের অংশে থাকবে। কোন বাড়িগুলো পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ হবে।

ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর ১৯৪৭-এর বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলা ও ভারতের পশ্চিম বাংলায় ছিটমহলের ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কুচবিহারসহ ১৯৪৭ সালে বিভাগীকরণ প্রক্রিয়া দেশীয় রাজ্যগুলোর জন্য নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার পরিবর্তে ভারত অথবা পাকিস্তানের যেকোন একটির সাথে মিলে যাওয়ার অপশন দেয়া হয়। পছন্দের জাতি-রাষ্ট্র বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে কুচবিহার সর্বশেষগুলোর মধ্যে একটি যারা ১৯৪৯ সালের আগস্টে ভারতের সাথে কুচবিহার একীভূত হওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। যেহেতু ছিটমহলগুলোকে শাসন করার কোন রেগুলেশন ছিল না, কুচবিহার মার্জার (ভারতের সাথে একীকরণ চুক্তি) চুক্তির পর এগুলো সার্বভৌম ভারত অথবা পাকিস্তানের ভূখন্ডের মর্যাদা প্রাপ্ত হয়। ১৯৪৭ সালে মাত্র ৩৬ দিনের মধ্যে ব্রিটিশরা ৮ কোটি লোক এবং ১,৭৫,০০০ বর্গমাইল ভূখন্ড ভাগ করে দেয়, যারা বিভিন্ন উপায়ে প্রায় ১,০০০ বছর যাবত একসাথে ছিল।

র‌্যাডক্লিফ কমিশন পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে সীমান্ত রেখা সৃষ্টি করেছিল। এসময় অনেক এলাকা অ-সীমাবদ্ধ থেকে যায়। ছিটমহলগুলো একটি বিভ্রান্ত্রিকর চিত্র তুলে ধরছিল যেখানে এলাকাগত দিক দিয়ে তাদের কোন কোনটি একটি দেশের অন্তর্গত, অথচ সার্বভৌম শাসনের দিক দিয়ে সেগুলো অপর রাষ্ট্রের। এগুলোকে অপদখলীয় এলাকা বলা হয়।

কিছু সমুদ্র সীমানা সম্পর্কিত ইস্যুও অমীমাংসিত থেকে যায়। সীমান্ত সংক্রান্ত কিছু ইস্যু বিবেচনার জন্য ১৯৪৮ সালের জুন মাসে (পাকিস্তানের) পূর্ব বাংলা এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মধ্যেকার সীমান্ত সংক্রান্ত ইস্যুগুলো বিবেচনার জন্য সুইডেনের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জাস্টিস অ্যালগট বাগ্গিকে প্রধান করে এবং ভারতের মাদ্রাজ হাইকোর্টের জাস্টিস সি. আইয়ার ও ঢাকা হাইকোর্টের জাস্টিস এম. শাহাবুদ্দীনকে সদস্য করে মোট তিন সদস্যের একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালের নাম ছিল “ইন্দো-পাকিস্তান বাউন্ডারি ডিসপুটস ট্রাইব্যুনাল”। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করে। ১৯৫০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এই ট্রাইব্যুনাল রিপোর্ট দাখিল করে। এই রিপোর্টে এই মর্মে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে ভারত ও পাকিস্তান সরকার (এই রিপোর্ট প্রকাশের) এক বছরের মধ্যে তাদের সীমান্ত চিহ্নিত করবে।

ছিটমহলগুলোকে মূলভূন্ডের সাথে যুক্ত করার জন্য একমাত্র চুক্তি করা হয়েছিল ১৯৫০ সালে। এই চুক্তির দ্বারা সরকারি কর্মকর্তারা তাদের অংশের ছিটমহলে প্রবেশ করতে পারত। কিন্তু জটিল প্রক্রিয়া এবং দুই রাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুতামূলক সম্পর্কের কারণে এই চুক্তি বাস্তবায়িত হয় নাই। ১৯৫২ সালে পাসপোর্ট ভিসার কড়াকড়ি এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বলবৎ হবার পূর্ব পর্যন্ত ছিটমহলের অধিবাসীরা কিছু মাত্রায় স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারত। এরপর থেকে ভারত ও বাংলাদেশ (বা এর পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানের) ছিটমহলের অধিবাসীগণ ক্রমান্বয়ে শারীরিক দূরত্বের কারণে রাষ্ট্রীয় নিয়ম কানুন ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। কারণ তারা ছিলেন মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন।

ভূখন্ড বিনিময়ের মাধ্যমে ছিটমহলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সব সময়েই রাজনৈতিবভাবে স্পর্শকাতর একটি বিষয় হিসাবে দেখা দিয়েছিল। আন্তসীমান্ত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সময় এটিকে বাদ দেয়া হয়েছে। যেমন পানি বন্টন এবং সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার ক্ষেত্রে।  তাছাড়া ভারতে ও বাংলাদেশে (অথবা পূর্বে পাকিস্তানে) কোন চুক্তি অনুমোদনের জন্য প্রয়োজন হয় সংবিধান সংশোধনের। ১৯৫০ সালে ছিটমহলগুলো বিনিময়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।  এসময় ভারত ও পাকিস্তান “ভূখন্ডগত লাভ বা ক্ষতি বিবেচনা না করেই” ছিটমহল বিনিময়ে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় নাই। অগ্নিগর্ভ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অস্থিতিশীল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কারণে অবাস্তবায়িত থেকে যায়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সীমান্ত সমস্যা নিরসনের প্রচেষ্টা:

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সরকারের সময় সীমান্ত সমস্যা সমাধান এবং ছিটমহল বিনিময়ের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্থল সীমান্ত চুক্তি (ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট/এলবিএ) স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৫০ সালের চুক্তি এবং ১৯৭৪ সালের উভয় চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য তৃতীয় আর একটি উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত ল্যান্ড বাউন্ডারি প্রোটোকল-এর মাধ্যমে। এই প্রোটোকল স্বাক্ষর করা হয়েছিল ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। এতদসত্ত্বেও, বাস্তবায়নের জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট সময়সীমা এই প্রোটোকলে ছিল না। ইতোমধ্যে, মাদক পাচার ও  চোরাকারবারি নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারত তার সাথে বাংলাদেশের সীমান্তের ৩,৪০৬ কি.মি.তারকাটা বেড়া দিয়েছে। পশ্চিম বাংলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ভারত ২৭৭ কি.মি.ব্যাপী ফ্লাড লাইট লাগিয়েছে।

   যাহোক, বিচ্ছিন্নতার কারণে এবং রাজনৈতিক জটিলতার কারণে সরকারের সাথেও ছিটমহল অধিবাসীরা যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছিলেন না। ছিটমহলগুলোর উপর সার্বভৌমত্ব আরোপ করার জন্য কোনো পক্ষই আন্তরিকভাবে ইচ্ছুক না থাকার পাশাপাশি মানবিক দিকদিয়ে ছিটমহল সমস্যা পুরোপুরি সমাধানের চেষ্টা করেন নাই। ছিটমহল অধিবাসীদের মৌলিক প্রয়োজন মিটানো এবং অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য তারা প্রতিনিয়তই সার্বভৌমত্বের গ্যাঁড়াকলে এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তকমা নিয়ে নির্দয় শিকারে পরিণত হচ্ছিলেন। এইসব ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষদের প্রচুর ভোগান্তি পোহাতে হত কারণ যেসব সরকারি সেবা তাদের প্রাপ্য ছিল সেগুলো তারা পাচ্ছিল না।

ভারতের মধ্যে থাকা বাংলাদেশী ছিটমহলগুলোর শতকরা ৭৫ভাগেরও বেশী অধিবাসীদের বৈধ ভ্রমণ ডকুমেন্ট ছাড়া ভারতে প্রবেশ করার কারণে গ্রেফতার হয়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের জেলে বন্দী থাকতে হয়েছে। ‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’ নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বছরের পর বছর অহিংস কর্মসূচী, অনশন ধর্মঘট ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছেন।

ভারতে বিজেপি সরকার এবং পরিস্থিতির পরিবর্তন:

২০১৪ সালে ভারতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা শ্রী নরেন্দ্র মোদী নির্বাচিত হওয়ার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে থাকে। এসময় ছিটমহল সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতীয় জনতা পার্টি সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যদিও ভারতীয় পার্লামেন্টর উভয় কক্ষে স্থল সীমান্ত চুক্তি ১৯৭৪ অনুমোদিত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরংকুশভাবে উভয় কক্ষেই তা অনুমোদিত হয়।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৪ সালেই বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে এলবিএ ১৯৭৪ অনুমোদন করিয়েছিলেন। ভারতে এটি অনুমোদিত হয় ৪১ বছর পর। এভাবে হস্তান্তরের পথ পরিস্কার হওয়ার পর বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুমোদনের ইনস্ট্রুমেন্ট বিনিময় করেন।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী ২০১৫ সালের ৬-৭ জুন বাংলাদেশ সফর করেন। সেসময় যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাতে ভারত বাংলাদেশর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়। সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারতের আইন সভায় অনুমোদিত স্থল সীমানা চুক্তি এবং ২০১১ সালের প্রোটোকল ভারতীয় পার্লামেন্টর উভয় কক্ষে অনুমোদিত হওয়ার দলিল এবং আনুষাঙ্গিক ইনস্ট্রুমেন্টগুলো বিনিময় করেন। এর দ্বারা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অটষট্টি বছরের পুরাতন সীমানা (পাকিস্তানের সাথে ১৯৭১এর পূর্বে ) বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে। যদিও আন্ত:সীমান্ত চলাচল, অভিবাসন, মানব পাচার ও চোরাকারবারি ইত্যাদির মত স্বল্প কিছু আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে  উদ্বেগ ও উত্তেজনা রয়ে গিয়েছে।

স্থল সীমানা চুক্তির বিষয়বস্তু অনুযায়ী ১৯৭টি ছিটমহলের মধ্যে ১৬২টি বিনিময় হয়েছে এবং ৫০০০ একর স্থলভূমি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অদলবদল হয়েছে। ভারত ৭১১০.০২ একর ভূমিসহ ৫১টি ছিটমহল এবং বাংলাদেশ ১৭,১৬০.৬৩ একর ভূমিসহ ১১১টি ছিটমহল পেয়েছে।

২০১৫ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৫ সালের ৬ জুন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে ভারত থেকে বাংলাদেশে ১৭,১৬০.৬৩ একর জায়গাসহ ১১১টি ছিটমহল হস্তান্তরের পথ সুগম হয়েছিল। বিপরীত দিকে, বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ৭১১০.০২ একর জায়গাসহ ৫১টি ছিটমহল ভারতের নিকট (বাংলাদেশ কর্তৃক) হস্তান্তরের পথ সুগম হয়।  এই ঐতিহাসিক চুক্তির আগে ২০১১ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধনমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে একটি প্রোটেকল স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রোটোকল দ্বারা উভয় দেশ অপদখলীয় সম্পত্তি ইস্যুগুলো সম্পর্কে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সম্মত হয়। ২০১১ সালের প্রোটোকল ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং পশ্চিম বঙ্গের সরকারগুলোর সম্মতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তা বাস্তবায়িত হতে পারে নাই।

এভাবে, ২০১১ সালের প্রোটোকলে প্রথমবারের মত উল্লিখিত ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম সীমান্তবর্তী আনুমানিক ৬.১ কি.মি. দীর্ঘ অনির্দিষ্ট স্থল সীমান্ত; ছিটমহল বিনিময়; এবং অপদখলীয় এলাকা সংক্রান্ত অনির্দিষ্ট স্থল সীমান্ত বিষয়গুলো ২০১৫ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তির দ্বারা বাস্তবায়িত হয়। এখানে এটি লক্ষ্যণীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে স্থল সীমান্ত বিনিময়, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ বেশী এলাকা লাভ করেছে।

উপসংহার:

 ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ছিট মহল বিনিময় সম্পন্ন হবার পর, স্থল সীমান্ত চুক্তি পরবর্তীকালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সমস্যা পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং আলোচনার জন্য বিজিবি এবং বিএসএফ-এর প্রতিনিধিগণ নতুন দিল্লীতে ২০১৫ সালের ২-৬ আগস্ট ৪১তম বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা পরবর্তী যৌথ বিবৃতিতে কর্মকর্তারা জানান যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য উভয় দেশের অফিসিয়ালদের সমন্বয়ে ‘কুইক রেসপন্স টিম’ গঠিত হবে।  স্থল সীমান্ত চুক্তি ছাড়াও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এইক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা সম্প্রসারণ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করার উপর জোর দেয়া হয়।

ভূখন্ড বিনিময় সূত্রপাত করার মত একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ সীমান্ত চুক্তির দ্বারা সম্পন্ন হলেও পন্ডিত এবং বিশ্লেষকগণ এব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে স্থল সীমান্ত চুক্তির পূর্বেকার পরিস্থতি পুরোপুরি ভাঙ্গা এখনও সম্ভব হয় নাই। বরঞ্চ স্থল সীমান্ত চুক্তির পূর্বেকার বছরগুলোতে যেসব সমস্যা ছিল সেগুলোর লক্ষণীয় উপস্থিতি অব্যাহত আছে, যদিও সমস্যাগুলোর পরিপ্রেক্ষিত বোধগম্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এবং এর ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ইতিবাচকভাবে সুদৃঢ় হওয়ার পথে এগিয়ে গিয়েছে। ছিটমহল বিনিময়ের ছয় বছর পর, স্থল সীমান্ত চুক্তির পূর্বেকার পরিস্থিতি থেকে স্থল সীমান্ত চুক্তির পরবর্তী পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য কতটুকু তা মূল্যায়ণের সময় এসেছে।

প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং আহ্বায়ক, বংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *