নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনার থাবায় স্থবির গোটা চীন। মহামারী মোকাবেলায় স্কুল থেকে শুরু করে অফিস আদালত সবকিছুই বন্ধ ঘোষণা করেছে চীন সরকার। ধ্বস নেমেছে সে দেশের অর্থনীতিতে। প্রতিনিয়তই বাড়ছে মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা। তবুও থামানো যাচ্ছে না করোনার থাবা।
সম্প্রতি সরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন চীনে পড়াশোনা করতে যাওয়া শিক্ষার্থীরা। তাদের একজনের সঙ্গে কথা হয় সময় সংবাদের। তার মুখে জানা যায় চীনের বর্তমান পরিস্থিতি।
কেমন আছেন চীনের জনগণ, কিভাবে কাটছে তাদের সময়, করোনা মোকাবেলায় চীন সরকার ও জনগণ কিভাবে কাজ করছে কিংবা ফেরত আসা শিক্ষার্থীরাই বা কিভাবে সেখানে কাটিয়েছেন করোনা সংক্রমণের দিনগুলো- এসব প্রসঙ্গে মুখ খোলেন এই শিক্ষার্থী।
চীনের ন্যানচ্যাং প্রদেশের জিয়াংশি নরমাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেন তৌহিদুল তাহসান। গত ৩ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরেছেন তিনি। করোনা ভাইরাসের দিনগুলোতে কেমন ছিলেন চীনে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চীনের অবস্থা সত্যি ভালো নয়। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে শহর লক-ডাউন করে দেয়া হয়। শুরুর দিকে কিছু সময়ের জন্য হলেও আমরা ইউনিভার্সিটির বাইরে যেতে পারতাম বাজার করতে। পরে সেটিও বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন সেখানে আরো কড়াকড়ি। ইউনিভার্সিটির গেটের বাইরেও যাওয়া নিষেধ। গেলেই সে দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী আটক করে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ক্যান্টিনের মাধ্যমে খাবারের অর্ডার করলেও সেটা অপ্রতুল। আজ অর্ডার করলে দু-তিন দিন পর পাওয়া যায়। তাও চাইনিজ খাবার। যার সঙ্গে আমরা অভ্যস্ত নই। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে আমার কাছে খবর আসে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি কিছু শিক্ষার্থী খাবার সংকটে ভুগছে। তাদের বের হতে দেয়া হচ্ছে না। তখন আমাদের ইউনিভার্সিটি কিছু সময়ের জন্য আমাদের বের হতে দিতো। পরে আমি নিজে গিয়ে বাজার করে তাদের পৌঁছে দিয়ে এসেছি।’
করোনা সংক্রমণের পর থেকেই বন্ধ আছে সে দেশের স্কুল, কলেজ ও অফিস আদালতগুলো। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে ছুটির মেয়াদ। কবে থেকে আবার সব খুলবে জানে না কেউ।
এ প্রসঙ্গে তৌহিদ বলেন, ‘১০ ফেব্রুয়ারি আমরা মেইলে খবর পেয়েছি সরকারিভাবে আগামী ১ মার্চ পর্যন্ত সে দেশের সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অফিস আদালত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে চীনের এখন যে পরিস্থিতি তাতে মনে হয় না মার্চেও খুলবে। আমাদেরকে বলা হয়েছে তোমরা যদি এখন চীন ছেড়ে চলে যাও, তাহলে পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত আর চীনে ফেরত আসতে পারবে না। তাই আমরা যারা ফেরত এসেছি, তারা কবে নাগাদ আবার চীন যেতে পারবো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
এমন পরিস্থিতিতে কেমন আছে চীনের জনগণ, কিভাবে তারা সময় কাটাচ্ছেন জানতে চাওয়া হয় তৌহিদের কাছে। জবাবে নিজের মোবাইলে ধারণ করা একটি ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে তৌহিদ বলেন, ‘আমরা যেদিন চীন থেকে দেশে ফেরত এসেছি সেদিন জিয়াংশি মেট্রো স্টেশনে লোক ছিলো মাত্র ৪ জন। তারা সবাই ছিলো বাংলাদেশি। মেট্রোতে উঠে দেখি আমরা ৪ জন ছাড়া আর একজন চাইনিজ রয়েছেন। ট্রেনের অন্য সব কামরা খালি। যেন এক ভূতুড়ে অবস্থা। অথচ অন্য সময় মেট্রোতে হাজার হাজার লোক থাকে। আর এখন রাস্তাঘাট সব কিছুই জনমানব শূন্য। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী আর অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। আমি চেয়েছিলাম সে দৃশ্যগুলো ধারণ করতে। তবে সে দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী খুবই কঠোরভাবে এসব নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই সবকিছু ভিডিও করা সম্ভব হয়নি।’
তৌহিদ জানান, কেউ যাতে বাসা থেকে বের না হয় সে জন্য মাইকিং করা হচ্ছে চীনে। অধিকাংশ প্রধান সড়কগুলো স্টিলের ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। সে সাথে নিয়োগ দেয়া হয়েছে স্থানীয় কিছু প্রতিনিধিও।
তৌহিদ বলেন, চীনা নতুন বছরের ছুটি চলাকালীন সময়ে সেখানকার বাজারগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকে। সে সময়টায় চীনের জনগণ এমনিতেই দু-তিন মাসের বাজার একসাথে করে রাখে। সে বাজার দিয়েই এখন চলছে অধিকাংশ চাইনিজদের। খুব জরুরী হলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে পরিচয় ও কাজের প্রয়োজনীয়তা বলে কিছু সময়ের জন্য পরিবারের একজনকে বের হতে দেয়া হচ্ছে। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় খুব বেশিদূর চাইলেও আপনি যেতে পারবেন না।
জানা যায়, ঘরে টিভি দেখে, গান শুনে কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার করেই আপাতত সময় পার করছেন চীনের জনগণ। তবে এতো কিছু সত্ত্বেও উন্নতির লক্ষণ নেই চীনের করোনা পরিস্থিতির। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও নিহতের সংখ্যা।
এ প্রসঙ্গে চীন ফেরত তৌহিদ বলেন, ‘আমার মনে হয়, নিহত ও আক্রান্তের সংখ্যা চীন কিছুটা হলেও গোপন রাখছে। নিজ চোখে দেখে আসা পরিস্থিতি বলছে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। তবে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে করোনা প্রতিরোধে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। চীন সরকার ও জনগণ এক জোট হয়েই লড়াই করছে। কত দিন লাগবে সফল হতে আমি জানি না। তবে, তাদের চেষ্টায় আসলেই কোনো ত্রুটি নেই।